ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, সিরিয়া, কাশ্মীর, চীন, মিয়ানমার এবং পৃথিবীর আরও বহু স্থানে মুসলমানরা আজ চরম দুর্দশায় রয়েছে। আমরা অনেকেই এমনটা মনে করি— আমরা দান-সদকার মাধ্যমে কিছুটা সহায়তা করতে পারি ঠিকই, কিন্তু তারপর আর আমাদের করার মতো তেমন কিছু থাকে না। কিন্তু আসলে তা নয়।
আমরা এখনো দুটো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পারি, এবং এই প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয় সেটিই:
১. দুআ করা।
২. নিজের আমল ও জীবন সংশোধন করা এবং সকল সেইসব কাজ থেকে ফিরে আসা, যা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “একজন মু’মিনের উপর দুনিয়ার জীবনে যত ক্লান্তি, অবসাদ, চিন্তা, দুঃখ, কষ্ট বা ক্ষতি এসে পড়ে—এমনকি একটি কাঁটাও যদি তাকে বিঁধে—তখনও আল্লাহ তার কিছু গুনাহ মোচন করে দেন।” [বুখারি]
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয়, সে শহীদ। যে ব্যক্তি নিজের দ্বীন রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয়, সে শহীদ। যে ব্যক্তি নিজের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয়, সে শহীদ। এবং যে ব্যক্তি নিজের পরিবার রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয়, সে শহীদ।” [তিরমিজি]
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “শহীদ ব্যক্তি নিহত হওয়ার সময় এমন ব্যথা অনুভব করেন, যেমন তোমাদের কেউ হালকা একটি কামড় বা চিমটি অনুভব করো।” [তিরমিজি]
শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়্যাহ رحمه الله বলেন,
“শামের (আল-শাম) অঞ্চল ইসলামের প্রারম্ভে দুনিয়া ও দ্বীনের দিক থেকে এক সুখকর অবস্থানে ছিল। অতঃপর ফিতনা দেখা দিল, এবং তাদের হাত থেকে কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেওয়া হল। তারপর মুনাফিক, বিদআতী ও ক্রুসেডাররা অত্যাচার চালিয়ে বায়তুল মাকদিস ও ইব্রাহিম عليه السّلام (قبر الخليل)- এর কবর দখল করে সেখানে থাকা স্থাপনাগুলিকে চার্চে রূপান্তরিত করল। কিন্তু যখন মুসলমানরা তাদের দ্বীন সংশোধন করল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ-এর আনুগত্য করল এবং তাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা অনুসরণ করল, তখন আল্লাহ তাদের সম্মান দান করলেন এবং তাদের শত্রুদের উপর বিজয় দিলেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যই হলো সুখের কেন্দ্রবিন্দু, এবং সমগ্র সুখ সেখানেই আবর্তিত হয়।” [মাজমু‘উল ফাতাওয়া]
যারা দুঃখ-কষ্টে রয়েছেন, আল্লাহ তাদের দুআ কবুল করবেন—আমাদের মাধ্যম ছাড়াই। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
“মজলুমের দুআ থেকে সাবধান! কেননা তার দোয়া ও আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা থাকে না।” [সহীহ, বুখারি ও মুসলিম]
দুআ অত্যন্ত সহজ, কিন্তু এটিই বাস্তবিক অর্থে আমাদের ভাই-বোনদের জন্য সবচেয়ে বড় সহায়তা। আল্লাহর দরবারে কাকুতি-মিনতি করা, মালিকুল-মুলুকের সামনে হাত তোলা—এটাই একজন মুমিনের অস্ত্র।
শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়্যাহ رحمه الله বলেন,
“মুসলমানদের অন্তরের খালিস দুআ ও তাদের সৎ কামনাগুলি একটি অপরাজেয় বাহিনী, যাদের সৈন্যরা কখনো দুর্বল হয় না।” [মাজমু‘উল ফাতাওয়া]
আমরা বারবার শুনেছি: “দুআ হলো মুমিনের অস্ত্র”। একজন মুসলিমের জন্য আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গড়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম দুআ। যখন বান্দা দুআ করে, সে স্বীকার করে যে সে আল্লাহর উপর ভরসা করে, তাঁর সাহায্যের মুখাপেক্ষী এবং একমাত্র তাঁর কাছেই প্রতিকার চায়।
হযরত আলী رضي الله عنه থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, “দুআ মুমিনের অস্ত্র, দ্বীনের স্তম্ভ এবং আকাশ ও পৃথিবীর নূর।”
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম رحمه الله বলেন, “দুআ হলো সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসাগুলোর একটি। এটি বিপদাপদের শত্রু। এটি বিপদকে দূর করে, সারিয়ে তোলে, আগমন ঠেকায় এবং যদি বিপদ আসে তাহলে তা হালকা করে। এটি মুমিনের অস্ত্র।”
দুআ ও কুনূত আন্ নাযিলাহ
যখন কোনো বিপদাপদ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মুসলিমদের উপর শত্রুর আক্রমণ অথবা উম্মাহর জন্য কোনো বড় দুর্যোগ দেখা দেয়—তখন Qunūt an-Nāzilah (قنوت النازلة) পাঠ করা সুন্নাহ।
আমাদের দুআগুলো বাহ্যিকভাবে সবচেয়ে সহজ আমল হলেও, এগুলিই প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী সাহায্য।
রাসূলুল্লাহ ﷺ যখন জানতে পারলেন যে ৭০ জন সাহাবীকে বনের কূপ (Bi’r Maʿūnah) এর কাছে প্রতারণা করে হত্যা করা হয়েছে, তখন তিনি ﷺ এক মাসব্যাপী ফজরের নামাজে কুনূত পাঠ করতেন। তিনি ﷺ তাদের বিরুদ্ধে দুআ করতেন, যারা সাহাবীদের হত্যায় জড়িত ছিল। [বুখারি]
আবু বকর আস-সিদ্দীক رضي الله عنه কুনূত পাঠ করতেন মুসায়লিমাহ আল-কাজ্জাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং আহলে কিতাব-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধকালে। [মিরকাতুল মাফাতীহ]
কীভাবে কুনূত আন্-নাযিলাহ (Qunūt an-Nāzilah) পড়া হয়?
১. কুনূত শেষ রাকাআতে, রুকু থেকে উঠে দাঁড়ানোর পর হাতে তুলে পড়া হয়। তবে কেউ চাইলে রুকুর আগে কুনূত পড়লেও জায়েয।
২. পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজেই কুনূত পড়া যায় এবং তা উচ্চস্বরে পড়া উত্তম—একাকী হোক কিংবা জামা’আতে।
৩. দুআর মাঝে মুসলিমদের জন্য হেফাজত চাওয়া এবং শত্রুর বিরুদ্ধে আল্লাহর সাহায্য ও প্রতিকারের আবেদন করা উচিত।
৪. যতদিন মুসলিমদের উপর আক্রমণ ও নির্যাতন চলতে থাকবে, ততদিন কুনূত চালিয়ে যাওয়া উত্তম।
৫. কোনো নির্দিষ্ট দুআর শব্দ আবশ্যক নয়। পরিস্থিতি অনুযায়ী দুআ করা যাবে।
ইমাম নববি رحمه الله বলেন,
“সঠিক অভিমত, যা অধিকাংশ আলিম বলেছেন, তা হলো কুনূতের জন্য কোনো নির্দিষ্ট দুআর শব্দ নেই; বরং পরিস্থিতি অনুযায়ী যে কোনো দুআ পড়া যায়।” [আল-মাজমু’]
উমার আল-ফারুক رضي الله عنه –এর একটি কুনূত আন্-নাযিলাহ, যা তিনি খ্রিস্টানদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় পড়তেন:
اللَّهُمَّ إِنَّا نَسْتَعِينُكَ وَنَسْتَغْفِرُكَ وَنُثْنِي عَلَيْكَ وَلا نَكْفُرُكَ ، وَنُؤْمِنُ بِكَ وَنَخْلَعُ وَنَتْرُكُ مَنْ يَفْجُرُكَ ، اللَّهُمَّ إِيَّاكَ نَعْبُدُ ، وَلَكَ نُصَلِّي وَنَسْجُدُ ، وَإِلَيْكَ نَسْعَى وَنَحْفِدُ ، وَنَرْجُو رَحْمَتَكَ وَنَخَافُ عَذَابَكَ إِنَّ عَذَابَكَ بِالْكُفَّارِ مُلْحَقٌ ، اللَّهُمَّ عَذِّبِ الْكَفَرَةَ ، وَأَلْقِ فِي قُلُوبِهِمُ الرُّعْبَ ، وَخَالِفْ بَيْنَ كَلِمِهِمْ ، وَأَنْزِلْ عَلَيْهِمْ رِجْسَكَ وَعَذَابَكَ ، اللَّهُمَّ عَذِّبْ كَفَرَةَ أَهْلِ الْكِتَابِ الَّذِينَ يَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِكِ وَيُكَذِّبُونَ رُسُلَكَ وَيُقَاتِلُونَ أَوْلِيَاءَكَ ، اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ ، وَالْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ ، وَأَصْلِحْ ذَاتَ بَيْنِهِمْ وَأَلِّفْ بَيْنَ قُلُوبِهِمْ ، وَاجْعَلْ فِي قُلُوبِهِمُ الإِيمَانَ وَالْحِكْمَةَ ، وَثَبِّتْهُمْ عَلَى مِلَّةِ رَسُولِكَ ، وَأَوْزِعْهُمْ أَنْ يُوفُوا بِعَهْدِكَ الَّذِي عَاهَدْتَهُمْ عَلَيْهِ ، وَانْصُرْهُمْ عَلَى عَدُوِّكَ وَعَدُوِّهِمْ ، إِلَهَ الْحَقِّ وَاجْعَلْنَا مِنْهُمْ
এ দুআর বাংলা অর্থ নিম্নরূপ:
“হে আল্লাহ! আমরা তোমার সাহায্য চাই, তোমার কাছে ক্ষমা চাই, তোমার প্রশংসা করি এবং কুফুরি করি না। আমরা তোমার উপর ইমান রাখি, এবং যারা তোমার নাফরমানি করে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হই। হে আল্লাহ! আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি, তোমারই জন্য সালাত ও সিজদা করি, এবং তোমার দিকেই এগিয়ে যাই ও চেষ্টা করি। আমরা তোমার রহমতের আশা করি এবং তোমার শাস্তিকে ভয় করি। নিশ্চয়ই তোমার শাস্তি কাফিরদের জন্য নির্ধারিত। হে আল্লাহ! কাফিরদের ধ্বংস করো, তাদের হৃদয়ে ভয় নিক্ষেপ করো, তাদের ঐক্য ভেঙে দাও, তাদের উপর তোমার গজব ও শাস্তি নাজিল করো। হে আল্লাহ! আহলে কিতাব কাফিরদের শাস্তি দাও—যারা তোমার পথে বাধা সৃষ্টি করে, তোমার রাসূলদের অস্বীকার করে এবং তোমার ওলীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। হে আল্লাহ! মু’মিন পুরুষ ও নারী, মুসলিম পুরুষ ও নারী—সকলকে ক্ষমা করো, তাদের মাঝে মিল তৈরি করো, তাদের হৃদয়ে ইমান ও হিকমাহ দান করো, তাদেরকে তোমার রাসূলের দ্বীনে দৃঢ় রাখো, এবং তোমার ওয়াদার উপর তাদেরকে অবিচল রাখার তাওফিক দাও। তাদেরকে তোমার ও তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে জয়যুক্ত করো। হে সর্বসত্যের প্রভু! আমাদেরকেও তাদের অন্তর্ভুক্ত করো।”
সাধারণ দুআর ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
দুআকে আরও শক্তিশালী করার জন্য আমি সবসময় তিনটি বিষয়কে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি:
১. আল্লাহর সুন্দর নাম ও গুণাবলী দিয়ে দুআ শুরু করা।
বিশেষ করে সেইসব আসমা’উল হুসনা, যা আপনার চাহিদার সাথে সম্পৃক্ত। যেমন: রিযিকের জন্য দুআ করলে “Ar-Razzāq (الرزاق)” নামটি ব্যবহার করা ইত্যাদি।
২. রাসূলুল্লাহ ﷺ-র প্রতি সালাওয়াত পাঠ করা — দুআর শুরুতে, মাঝে এবং শেষে।
আপনার দুআকে যত বেশি সম্ভব সালাওয়াতের ঘিরে রাখুন। ভাবুন যেন এগুলো দুআর প্রহরী, যারা দুআটিকে নিরাপদে আল্লাহর দরবারে পৌঁছে দেয়।
৩. দুআর মধ্যে আপনার পিতা-মাতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা অনুপস্থিত না রাখা।
তাঁদের মর্যাদা আল্লাহর দৃষ্টিতে অত্যন্ত উঁচু এবং অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত।
এই বিষয়গুলো এখনই ঠিক করে ফেলুন
দুআর পাশাপাশি আমাদের উচিত নিচের কাজগুলো অবিলম্বে শুরু করা:
- যিকর ও ইস্তিগফারে বৃদ্ধি করা
- নিয়মিত ও সময়মতো সালাত আদায় করা
- আল্লাহর কালাম কুরআনের সাথে সম্পর্ক নবায়ন করা, প্রতিদিন অন্তত এক পৃষ্ঠা হলেও তিলাওয়াত করা
- তাহাজ্জুদের সালাতে দাঁড়ানো এবং রাতের শেষ ভাগে আল্লাহর দরবারে আকুতি জানানো
- সুদ ও হারাম থেকে বেঁচে থাকা
- নিজের আমলগুলোর তদারকি করা এবং যেগুলো হারাম বা মাকরুহ, সেগুলো পরিহার করা
- দান-সদকা ও দরিদ্রদের সাহায্যে অগ্রসর হওয়া
- আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
“আল্লাহ ততক্ষণ তার বান্দাকে সাহায্য করতে থাকেন, যতক্ষণ সে তার ভাইয়ের প্রয়োজনে সাহায্য করতে থাকে।”
[আল-মুজাম আল-কবীর]
- সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আমাদের অন্তরকে আল্লাহর প্রতি বিনয়ী করে তোলার চেষ্টা।
দুশমনরা একত্রিত হচ্ছে, আমাদেরকেও আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে হবে
আজকের দিনে ইসলামের শত্রুরা একজোট হয়ে মুসলিমদের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। নতুন ফেরাউনরা আবির্ভূত হয়েছে, কিন্তু আল্লাহ সবসময় তাঁর অনুগত বান্দাদের জন্য পথ খুলে দেন এবং বিজয় দেন—তাদেরকে যারা: ধৈর্যধারণ করে, তাওয়াক্কুল করে এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরে।
আল্লাহ বলেন,
وَمَن يَتَوَلَّ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ فَإِنَّ حِزْبَ ٱللَّهِ هُمُ ٱلْغَـٰلِبُونَ "আর যে কেউ আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মু’মিনদের পক্ষ অবলম্বন করে—নিশ্চয়ই আল্লাহর দলই বিজয়ী হবে।" [সূরা আল-মায়িদাহ, ৫৬]
সাহাবারা সবকিছু ছেড়ে দিলেন তাদের নবীর ﷺ ডাকে সাড়া দিয়ে। তাদের অবস্থা ছিল বানী ইসরাইলের সেই অংশের মতো যারা মূসা عليه السلام-কে অনুসরণ করেছিল। কিন্তু দু’দলের মাঝে পার্থক্য ছিল, কে কতটা তাঁদের নবীর আদেশ মেনে চলেছে।
সহায়তা আসে কেবল আল্লাহর কাছ থেকেই
আমরা প্রায়ই শুনি: “আজ আমাদের মাঝে সালাহুদ্দীন আইয়ূবি, নূরুদ্দীন যঙী, খালিদ ইবনু ওয়ালিদ, উমর ইবনুল খাত্তাব, বা বাদশাহ ফয়সল নেই, তাই আমরা দুর্বল।” এটা আসলে একটি ভুল দৃষ্টিভঙ্গি, এবং এই মনোভাবই আমাদের এমন একটি সমাজ তৈরি করতে বাধা দিচ্ছে—যেখানে এমন মহামানবরা জন্ম নিতে পারে। এদের প্রত্যেকেরই আত্মিক গঠনের পেছনে ছিল আল্লাহর মহব্বত ও সুন্নাহর ওপর প্রতিষ্ঠিত এক “তারবিয়াহ”। আমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে কেবল মাধ্যম (means) নিয়ে ভাবছি, কিন্তু মূল উৎস (cause)—যিনি আল্লাহ—তাঁকে ভুলে গেছি।
উমর ইবনুল খাত্তাব رضي الله عنه একবার খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ رضي الله عنه-কে জেনারেল পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন, কারণ মানুষ মনে করতে শুরু করেছিল, জয় আসছে শুধুই খালিদের কারণে, আল্লাহর ইরাদার কারণে নয়। আমাদের এখনই আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে হবে। আল্লাহকেই আমাদের সব চেষ্টার কেন্দ্রবিন্দু বানাতে হবে।
রিবা: দুআর সামনে প্রতিবন্ধকতা
আমরা দুআ করেছি, দান-সদকা দিয়েছি, ক্ষমতাবানদের চাপ দিয়েছি যেন তারা কিছু করে, এবং আরও অনেক কিছু করেছি। কিন্তু অন্যদিকে, আমরা কি এমন কিছু করছি না যার কারণে আমাদের দুআ কবুল হচ্ছে না?
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম رحمه الله বলেন, “দুআ করা ও আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া—এই দুটো অস্ত্রের মতো। যেমনটা জানা কথা, অস্ত্র তখনই কার্যকর হয়, যখন তা দক্ষ হাতে ব্যবহৃত হয়। শুধু ধারালো হলেই চলে না। অস্ত্র যদি ত্রুটিমুক্ত হয়, ব্যবহারকারী যদি শক্তিশালী হয় এবং কোনো বাধা না থাকে, তবে শত্রুকে সহজেই পরাস্ত করা যায়। কিন্তু যদি এই তিনের কোনো একটি দুর্বল হয়, তাহলে ফলাফলও সেই অনুযায়ী দুর্বল হবে।”
[আদ্-দা’ ওয়াদ্-দাওয়া]
তিনি আরও বলেন, “দুআ হচ্ছে এমন একটি শক্তিশালী মাধ্যম, যা অকল্যাণ দূর করে এবং কাঙ্ক্ষিত কল্যাণকে নিয়ে আসে। কিন্তু দেখা যায় যে, অনেক সময় এর প্রভাব দেখা যায় না। কেন? হয়তো দুআতে দুর্বলতা আছে—যেমন দুআ আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয়, কারণ তাতে সীমালঙ্ঘন আছে। অথবা দুআকারী ব্যক্তির অন্তর দুর্বল—যার কারণে সে পূর্ণ মনোযোগ ও আন্তরিকতা নিয়ে আল্লাহর কাছে কিছু চায় না। ফলে দুআ একটি দুর্বল ধনুকের মতো হয়, যেখান থেকে তীরটি বের হয় দুর্বলভাবে। আরেকটি বড় কারণ হতে পারে—এমন কোনো প্রতিবন্ধকতা, যেমন হারাম খাবার খাওয়া, জুলুম করা, গুনাহের কারণে অন্তরে কালিমা জমে যাওয়া, অথবা অন্তর খেল-তামাশা ও গাফেলতিতে ডুবে যাওয়া।”
রিবার (সুদ) ধ্বংসাত্মক প্রভাব
আমাদের সমাজ বর্তমানে রিবা ও ঋণের মধ্যে ডুবে আছে। এটা কেন এত বড় সমস্যা? কারণ অন্যান্য গুনাহ, যেমন: সালাত অবহেলা করা, গীবত, মিথ্যা বলা—এগুলো ব্যক্তিগত পর্যায়ে সংশোধন করা যায়। কিন্তু রিবা এমন একটি সমস্যা যা সামষ্টিকভাবে গোটা উম্মাহকে গ্রাস করেছে। এ কারণেই আজকের লেখার মূল ফোকাস— রিবার ক্ষতিকর প্রভাব। রিবার প্রভাব এতটা ছড়িয়ে পড়েছে যে, একভাবে বা অন্যভাবে এটি আমাদের জীবনে ঢুকে পড়েছে, এবং এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক।
আল্লাহ বলেন,
فَإِن لَّمْ تَفْعَلُوا۟ فَأْذَنُوا۟ بِحَرْبٍۢ مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ۖ وَإِن تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُءُوسُ أَمْوَٰلِكُمْ لَا تَظْلِمُونَ وَلَا تُظْلَمُونَ
“যদি তোমরা (রিবা) ছেড়ে না দাও, তাহলে জেনে রাখো, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু যদি তোমরা তাওবা করো, তাহলে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই থাকবে—তোমরা কারও প্রতি জুলুম করবে না, কেউ তোমাদের উপর জুলুম করবে না।”
[সূরা আল-বাকারা, ২৭৯]
এই সতর্কবাণী এতটাই ভয়ানক যে কুরআনের আর কোথাও এমন ভাষায় হুমকি আসেনি, শুধু কুফর ছাড়া।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, “আল্লাহ রিবা গ্রহণকারী, প্রদানকারী, রিবার সাক্ষী, এবং যে লেনদেনটি লিপিবদ্ধ করে—এই চারজনের উপর লা‘নত করেছেন।” [সহীহ মুসলিম]
আমরা আল্লাহর সাহায্য চাই, অথচ আমাদের অনেক কর্মকাণ্ডের উপর আল্লাহর লা‘নত। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ যদি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, তখন আমরা কোন সাহসে সাহায্য প্রত্যাশা করি?
রসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, “যখন তোমরা ‘ইনাহ’ -কে লেনদেনে প্রবেশ করো, গরুর লেজ আঁকড়ে ধরা, চাষাবাদে মগ্ন হও এবং জিহাদ পরিত্যাগ করো—তখন আল্লাহ তোমাদের উপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দেবেন এবং তা সরাবেন না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের আসল দ্বীনের দিকে ফিরে আসো।” [আবু দাউদ]
ইনাহ[১] লেনদেন এক ধরনের রিবা, যার মাধ্যমে মানুষ দুনিয়ার আরাম-আয়েশ, সন্দেহজনক ব্যবসা, এবং রিবার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনে লিপ্ত হয়।
এর প্রভাব কী সমাজে পড়ছে?
রাসূল ﷺ বলেন, “খুব শিগগিরই অন্যান্য জাতিগুলো তোমাদের বিরুদ্ধে এক অপরকে এমনভাবে আহ্বান করবে, যেমন মানুষ একে অপরকে দাওয়াত দেয় ভোজে অংশ নিতে।” সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, “তখন কি আমরা সংখ্যায় কম হব?” তিনি বললেন, “না, বরং তোমরা তখন সংখ্যায় অনেক হবে, কিন্তু তোমরা স্রোতে ভেসে যাওয়া ফেনার মতো দুর্বল হবে। আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের অন্তর থেকে তোমাদের ভয় দূর করে দেবেন এবং তোমাদের অন্তরে দুর্বলতা ঢুকিয়ে দেবেন।” জিজ্ঞেস করা হল, “হে আল্লাহর রাসূল ﷺ! এই দুর্বলতা কী?” তিনি বললেন, “দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা এবং মৃত্যুকে ঘৃণা করা।” [আবু দাউদ]
একটি ভয়াবহ হাদীস
ইমাম আহমদের “মুসনাদ”-এ বর্ণিত হয়েছে: “এক সময় আসবে, যখন সবাই রিবা গ্রহণ করবে।” কেউ বললো, “সবাই?” তিনি ﷺ বললেন, “যে কেউ সরাসরি গ্রহণ না করলেও, রিবার ধূলা তার গায়ে লাগবেই।” এই হাদীসই আমাকে প্রতিবার কাঁপিয়ে তোলে।
সহীহ মুসলিম-এ একটি বর্ণনা: রাসূল ﷺ একজন লোকের কথা বলেন, “সে দূর-দূরান্ত থেকে সফর করে এসেছে, চুল এলোমেলো, শরীর ধুলোময়। সে আকাশের দিকে হাত তুলে বলে: ‘হে রব! হে রব!’ অথচ তার খাবার হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম, তার দেহ হারাম খাদ্যে লালিত—তাহলে তার দুআ কীভাবে কবুল হবে?” [সহীহ মুসলিম]
আমাদের এক উস্তাদ একটি আয়াত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন:
وَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِينَ
“তোমরা সেই আগুন থেকে বেঁচে থাকো, যা কাফিরদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।” [সূরা আলে ইমরান, ১৩১]
তিনি বলেন, এই আয়াতে যেহেতু রিবার হুমকি জাহান্নামের সাথে দেয়া হয়েছে—যা কাফিরদের জন্য নির্ধারিত—তাই বোঝা যায়, রিবার গুনাহ এক সময় মানুষকে কুফরের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে।
ইমাম আবু হানিফা رحمه الله বলেন, “মুমিনদের ব্যাপারে কুরআনের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন আয়াত এটি—যেখানে বলা হয়েছে, যদি তারা রিবা না ছাড়ে, তাহলে সেই আগুন তাদের জন্যও রয়েছে।”
ছোট ছোট বিষয়ে রিবা
এখানে আমি শুধু একটি ছোট উদাহরণ তুলে ধরতে চাই, যাতে বোঝা যায় আমাদের সমাজে কত সাধারণ কিছু কাজ কতটা সহজে রিবার দিকে নিয়ে যেতে পারে — কিংবা তা সরাসরি রিবা হয়ে যায়।
আল্লাহ বলেন:
وَمَآ ءَاتَيْتُم مِّن رِّبًۭا لِّيَرْبُوَا۟ فِىٓ أَمْوَٰلِ ٱلنَّاسِ فَلَا يَرْبُوا۟ عِندَ ٱللَّهِ ۖ وَمَآ ءَاتَيْتُم مِّن زَكَوٰةٍۢ تُرِيدُونَ وَجْهَ ٱللَّهِ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْمُضْعِفُونَ
“তোমরা মানুষদের ধনে বাড়তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে যা কিছু সুদ (রিবা) দিয়ে থাকো, তা আল্লাহর নিকট বৃদ্ধি পায় না। আর তোমরা যা কিছু যাকাত দাও আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে, তারাই বহুগুণে প্রতিদানপ্রাপ্ত হবে।” [সূরা আর-রূম, আয়াত ৩৯]
এই আয়াতটি মক্কায় রিবার বিষয়ে অবতীর্ণ হওয়া প্রাথমিক আয়াতগুলোর একটি। বলা যায়, এটি একটি ভিত্তি স্থাপন করছিল এবং মানুষকে সুদবিহীন একটি অর্থব্যবস্থার চিন্তার দিকে উৎসাহিত করছিল। আল্লাহ এই আয়াতে দুটি বিপরীত বিষয়কে তুলে ধরেছেন — একদিকে রিবা, অন্যদিকে যাকাত। মনে হচ্ছে যেন যাকাতকে রিবার প্রতিষেধক হিসেবে দেখানো হয়েছে। রিবা যেখানে সমাজকে শোষণ করে, যাকাত সেখানে সমাজকে শক্তিশালী করে।
তাফসিরবিদদের মধ্যে যেমন ইবন আব্বাস, মুজাহিদ, কাতাদা, ইকরিমা, ও আশ-শা‘বি رحمهم الله এরা বলেন যে, এই আয়াতে “রিবা” বলতে উপহার (gift) বোঝানো হয়েছে — এবং এটাই আমার চিন্তাকে নাড়া দিয়েছে।
মুফতি শফী উসমানী رحمه الله আমাদের উপমহাদেশে প্রচলিত একটি ব্যাপার সম্পর্কে সতর্ক করেন যা আমরা অনেক সময় খুব হালকাভাবে নেই। তিনি বলেন:
“এই আয়াতটি একটি খারাপ রীতিকে সংশোধনের জন্য এসেছে, যা আত্মীয়স্বজন এবং বৃহত্তর পরিবারগুলোর মধ্যে প্রচলিত। যখন মানুষ কোনো আত্মীয়কে উপহার বা হাদিয়া দেয়, বিশেষত বিয়ের সময়, তখন তারা কত টাকা দিয়েছে তা লিখে রাখে এই আশায় যে, পরে তাদের সময়ে তার চেয়ে বেশি কিছু তারা ফেরত পাবে… যে কেউ এমন কিছু দেয় এই উদ্দেশ্যে যে পরে তার চেয়ে বেশি কিছু পাবে, তা আল্লাহর নিকট কোন সওয়াবের যোগ্য নয়। কুরআনে একে রিবা বলা হয়েছে, যেন বোঝানো হয়েছে এটি সুদের মতোই খারাপ।” [মা‘আরিফুল কুরআন]
আমাদের শাইখ ড. ইব্রাহিম নূহু حفظه الله বলেছিলেন:
“যদি কেউ কারো থেকে ঋণ নেয়:
১. যদি সে ঋণ ফেরতের পাশাপাশি আরও কিছু অতিরিক্ত ফি বা শাস্তিমূলক অর্থ দেয়ার প্রত্যাশা করে বা চুক্তির অংশ হয় — এটি হারাম এবং রিবার একটি ধরন।
২. যদি সে প্রত্যাশা করে যে, কোনো না কোনোভাবে উপহার ইত্যাদি পাবে, যদিও চুক্তিতে এর উল্লেখ নেই — এটিও হারাম এবং রিবার মধ্যে পড়ে যেতে পারে।
৩. যদি সে কিছুই প্রত্যাশা না করে, শুধুমাত্র নিজের অর্থটাই ফেরত পেতে চায় — তাহলে এমন ব্যক্তিকে উপহার দেয়া বা কোনো বাড়তি কিছু দেয়া শুধু বৈধই নয়, বরং শরিয়তে প্রশংসনীয়। এটি মানুষকে আরও ঋণ দিতে উৎসাহিত করে, ভালোবাসা বৃদ্ধি করে, সম্পর্ক দৃঢ় করে এবং আরও অনেক উপকার হয়।
নীতিমালা: ‘যে কোনো ঋণ যা থেকে কোনো লাভ অর্জিত হয়, সেই লাভই হচ্ছে রিবা।’
[শরহ বুলুগুল মারাম, IIUM]
ইসলামের শত্রুরা একত্রিত হয়ে রিবা ও ঋণের মাধ্যমে তাদের যুদ্ধগুলো অর্থায়ন করছে — এটা দেখে ওয়াল্লাহি, আমার মনে পড়ে শুধু উহুদ ও আহযাব যুদ্ধের কথা। সীরাহর সেই অধ্যায়গুলো, যেখানে কুরাইশ ও কনফেডারেট (মোত্তাহিদ) বাহিনী সুদের টাকায় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল এবং তাদেরকে দেখে মনে হতো যেন তারা আরবের সবচেয়ে শক্তিশালী শক্তি। অথচ রিবা হলো এমন একটি বিষয় যার উপর আল্লাহ নিজেই কুরআনে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। যাদের ভিত্তিই যদি অন্যায় ও ভঙ্গুর হয়, তারা বেশিদিন টিকতে পারে না। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার।
কনফেডারেট বাহিনীর বিশালতায় মুগ্ধ হওয়ার প্রসঙ্গে, আমরা একটি আরেকটি ঘটনার দিকে তাকাই যা হীনমন্যতা (inferiority complex)-এর ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আমাদের সতর্ক করে।
আমাদের নবী মুহাম্মদ ﷺ-এর আগমনের সময় পৃথিবীতে আর কোনো নবী জীবিত ছিলেন না, তবে পূর্ববর্তী কিছু নবীর প্রতিষ্ঠিত শরিয়াহর কিছু অংশ টিকে ছিল। ইবরাহিম ও ইসমাঈল عليهما السلام -এর শরিয়াহ যেমন — হজ্বের রীতি, আল্লাহর ডাকে সাড়া দেয়া ইত্যাদি ছিল — কিন্তু ধীরে ধীরে তা বিকৃত হয়ে গিয়েছিল।
মক্কার একজন লোক আমর ইবনে লুহাই উত্তর আরবের নাবাতিয়ান (বর্তমান শাম) অঞ্চলে সফর করেন এবং সেখানে একটি বিশাল মূর্তি — হুবাল — দেখে মুগ্ধ হন। যারা এই মূর্তিকে পূজা করছিল তারা ছিল সে অঞ্চলের ক্ষমতাধর ও সামরিক-অর্থনৈতিকভাবে সফল। হীনমন্যতার কারণে তিনি মনে করলেন, এত উন্নত জাতি যদি এ মূর্তিকে পূজা করে তবে নিশ্চয়ই তাদের পথ সঠিক। তিনি মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে মূর্তিটি কিনে এনে কা‘বার আঙ্গিনায় স্থাপন করেন।
এই ব্যক্তি ছিলেন তার গোত্রের নেতা, সম্মানিত ও প্রভাবশালী। তাই যখন তিনি একটি ‘নতুন ধারণা’ নিয়ে এলেন, মানুষ চোখ বন্ধ করে তার অনুসরণ করল। ইসমাঈল عليه السلام-এর যুগ থেকে আমর ইবনে লুহাই পর্যন্ত প্রায় ২০০০ বছর কোনো নবী বা ওহির আগমন ঘটেনি। এই দীর্ঘ সময়ে জাহালাত (অজ্ঞতা) ছড়িয়ে পড়েছিল, আর মানুষ ধীরে ধীরে ইসমাঈল ও ইবরাহিম عليهما السلام-এর শরিয়াহ থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিল।
কারণ, তুমি যদি কোনো বিষয় থেকে দীর্ঘ সময় দূরে থাকো, সেটি এক সময় হারিয়ে যাবে। শরিয়াহর পবিত্রতা ও দৃঢ়তা সম্পর্কে জ্ঞান না থাকার কারণে মানুষ সহজেই শত্রুদের ‘ঝলমলে’ সংস্কৃতি ও আচার-আচরণে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল এবং পূর্ববর্তী হক পথকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। তারা যখন শিরক-এর দরজা খুলে দেয়, তখন তা ডমিনো ইফেক্ট-এর মতো একে একে বিদআত, অপকর্ম, ও কুফরি আচরণ গ্রহণের দরজা খুলে দেয়।
পরবর্তীতে তারা এতটাই সাহসী হয়ে ওঠে যে তারা দাবি করে বসে, তারা ইবরাহিম عليه السلام-এর অনুসরণকারী — অথচ প্রকৃতপক্ষে তারা শুধু নিজেদের খেয়াল-খুশি এবং পূর্বপুরুষদের গোঁড়া ধর্মের অনুসরণ করছিল একটি ধর্মীয় মুখোশ পরে। সবকিছু মিলিয়ে আজ ১৪৪৫ হিজরি/২০২৩ সালের বাস্তবতার সাথে কি এসব পরিচিত লাগছে না?
আমি এখানে কী ভূমিকা রাখতে পারি?
আপনি হয়তো ভাবছেন — “এর মধ্যে আমার ভূমিকা কী?” — বাস্তবে, অনেক বড় একটি ভূমিকা। একজন ব্যক্তি হতে পারেন পরিবর্তন আনার মাধ্যম, আবার তিনিই হতে পারেন ধ্বংসের কারণ।
আল্লাহ বলেন,
ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُم بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
“স্থলে ও সমুদ্রে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের হাতের কামাইয়ের কারণে, যাতে করে আল্লাহ তাদেরকে তাদের কিছু কৃতকর্মের স্বাদ আস্বাদন করান — যাতে তারা ফিরে আসে (তাওবা করে)।” [সূরা আর-রূম, ৪১]
ইবন উমর رضي الله عنه বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ একবার সাহাবাদের দিকে ফিরে বললেন:
“হে মুহাজিরগণ! পাঁচটি জিনিস আছে, যেগুলোর মাধ্যমে তোমাদের পরীক্ষা করা হবে। আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই যেন তোমরা সেগুলো প্রত্যক্ষ না করো। যখন কোনো জাতির মাঝে নির্লজ্জতা এতটা ছড়িয়ে পড়বে যে তারা তা প্রকাশ্যেই করতে থাকবে, তখন তাদের মধ্যে এমন মহামারী ও রোগ ছড়িয়ে পড়বে যা তাদের পূর্বপুরুষরাও কখনও দেখেনি। যখন তারা ওজনে ও মাপে ধোঁকা দেবে, তখন তাদের উপর দুর্ভিক্ষ, ভয়াবহ দুর্যোগ এবং শাসকদের জুলুম নেমে আসবে। যখন তারা যাকাত আদায় করা বন্ধ করে দেবে, তখন আকাশ থেকেও বৃষ্টি বন্ধ করে দেওয়া হবে। যদি জমিনে পশুরা না থাকতো, তাহলে এক ফোঁটাও বৃষ্টি নামতো না। যখন তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করবে, তখন আল্লাহ তাদের উপর শত্রুদের চাপিয়ে দেবেন, এবং তারা যা কিছু ধরে রাখে তা শত্রুরা নিয়ে যাবে। যখন তাদের নেতারা আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী শাসন করবে না এবং আল্লাহর অবতীর্ণ বিধানের বাইরে সমাধান খুঁজবে, তখন আল্লাহ তাদের নিজেদের মধ্যেই সংঘাতে জড়িয়ে ফেলবেন।”
[ইবন মাজাহ]
এখন আসুন এমন একটি গল্প দেখি, যা সাধারণ হলেও অত্যন্ত গভীর বার্তা বহন করে।
ইমাম ইবন কুদামাহ رحمه الله একটি ঘটনা বর্ণনা করেন (সম্ভবত এটি ইসরাইলিয়াত), যেখানে হযরত মূসা عليه السلام ও তাঁর কওম বানী ইসরাইল-এর উপর একবার প্রবল খরা নেমে আসে। তারা আকাশের দিকে হাত তুলে দোয়া করছিল যে আল্লাহ যেন তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করেন। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল যে আকাশের যে সামান্য কিছু মেঘ ছিল, সেগুলাও মিলিয়ে গেল। গরম আরও বেড়ে গেল, খরা আরও ভয়াবহ রূপ নিল। এরপর আল্লাহ ওহি পাঠালেন, যাতে জানানো হয়: “তোমাদের মাঝে একজন ব্যক্তি রয়েছে, যে চল্লিশ বছর ধরে আল্লাহর অবাধ্যতা করে আসছে। সে যদি এই জমায়েত থেকে বের না হয়, তবে আমি তোমাদের উপর বৃষ্টি দেব না।”
তখন মূসা عليه السلام লোকদের বললেন: “আমাদের মাঝে একজন ব্যক্তি রয়েছে যে চল্লিশ বছর ধরে আল্লাহর নাফরমানি করে আসছে। সে যদি বের হয়ে না যায়, তবে আমরা এই খরা থেকে মুক্তি পাব না।”
সেই ব্যক্তি চারদিকে তাকাতে লাগল — কেউ সামনে এগিয়ে আসছে না। একসময় তার বুক কেঁপে উঠল, সে বুঝতে পারল, তার কথাই বলা হয়েছে। যদি সে দাঁড়িয়ে না আসে, তবে সবাই তৃষ্ণায় মরবে। কিন্তু যদি সে সামনে আসে, তবে চিরদিনের জন্য লাঞ্ছিত হবে। এই সংকটে, সে পূর্বে কখনও না করা এক আন্তরিকতা নিয়ে আল্লাহর দিকে হাত তুলল। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছিল। সে বলল, “হে আল্লাহ! আমার প্রতি দয়া করুন! আমার গুনাহ ঢেকে দিন! হে আল্লাহ, আমাকে ক্ষমা করে দিন!” অবাক করার বিষয় মুহূর্তেই আকাশে মেঘ জমে উঠল এবং প্রবল বৃষ্টি শুরু হলো।
মূসা عليه السلام তখন আল্লাহর নিকট বললেন: “হে আল্লাহ! আপনি তো বলেছিলেন, গুনাহগারকে বের হতে হবে, অথচ কেউ বের হয়নি — তবুও আপনি বৃষ্টি দিলেন?” আল্লাহ উত্তর দিলেন: “হে মূসা, আমি পুরো বানী ইসরাইলকে বৃষ্টি দিলাম ওই ব্যক্তি তাওবা করেছিল বলেই।”
মূসা عليه السلام তখন বললেন: “হে আল্লাহ! আমাকে দেখিয়ে দিন সেই ব্যক্তিকে!” আল্লাহ বললেন: “হে মূসা! আমি তো তার গুনাহ ৪০ বছর ঢেকে রেখেছি। এখন সে যখন তাওবা করেছে, তুমি কি চাও আমি তাকে প্রকাশ করে দেই?”
[কিতাব আত-তাওয়াবীন]
এটাই সেই কারণগুলোর একটি, যার জন্য আলেমরা বারবার তাওবার দিকে আহ্বান করেন এবং বলেন নিজেদের অবস্থা ঠিক করো — যদি চাও আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করুন। এ বিষয়ে অসংখ্য আয়াত ও হাদীস রয়েছে।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম رحمه الله বলেন: “পাপীর খারাপ প্রভাব কেবল তার উপরই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তার আশেপাশের মানুষ, এমনকি পশুপাখির ওপরও তা পড়ে। তাদেরকেও এর ক্ষতির স্বাদ আস্বাদন করতে হয়।”
[আল-জাওয়াব আল-কাফি]
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: “মুমিনদের পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়া ও সহানুভূতির দৃষ্টান্ত একটি দেহের মত। যখন দেহের কোনো একটি অঙ্গ ব্যথায় কাতর হয়, তখন পুরো দেহ নিদ্রাহীনতা ও জ্বরে প্রতিক্রিয়া দেখায়।”
আর অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন: “নিশ্চয়ই মুমিনরা একটি দালানের ইটের মতো, এক অংশ অন্য অংশকে শক্তি জোগায়।” এ কথা বলার সময় তিনি ﷺ তাঁর আঙুলগুলোকে একে অপরের সাথে জড়িয়ে দেখিয়েছিলেন। [বুখারী ও মুসলিম]
রিবা আমাদের সমাজকে দুর্বল করে দিচ্ছে ও ধ্বংস করছে। এটি গরিবদেরকে আরও গরিব করে রাখে, আর মধ্যবিত্তদেরকে ঋণের চক্রে ফেলে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয়, অথচ ধনীদের সম্পদ আরও বাড়তেই থাকে—কোনো বাস্তব মূল্য সৃষ্টির বাইরে গিয়ে। রিবা একটি মরীচিকার মতো। বাইরে থেকে মনে হয় আপনি অর্থ পাচ্ছেন, কিন্তু বাস্তবে এতে কোনো বরকত থাকে না। এটি পোকামাকড়ের মতো ধীরে ধীরে আপনার সম্পদকেও খেয়ে ফেলে এবং আত্মাকেও ধ্বংস করে দেয়।
তাহলে এখনই কি সেই সময় নয়, যখন আমরা অন্তত জেগে উঠি এবং আমাদের লেনদেনে রিবার বিপরীতে কাজ করার চেষ্টা করি? তাৎক্ষণিক প্রভাব নাও দেখা যেতে পারে, এটি বিশাল শ্রম ও কুরবানি দাবি রাখে এবং অনেক মানুষও হয়তো খুশি হবে না। কিন্তু আল্লাহ আমাদের নিয়ত দেখেন।
আল্লাহ কেন মন্দকে অনুমতি দেন?
যখন যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিপদাপদ ইত্যাদির প্রসঙ্গ আসে — বিশেষ করে যখন শিশু ও নিরীহ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় — তখন এ প্রশ্নটি খুব সাধারণভাবে উঠে আসে। মন্দ বলতে আমরা বুঝতে পারি — ভালোর অনুপস্থিতি। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা ভালো ও মন্দকে সাধারণভাবে এভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি:
- ভালো: যা মানুষের প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সুখ ও স্বস্তি এনে দেয়।
- মন্দ: যা মানুষের প্রকৃতির বিরুদ্ধে যায় এবং কষ্ট ও অস্বস্তি সৃষ্টি করে।
মন্দ দুই প্রকার:
- নৈতিক মন্দ (Moral Evil): মানুষের ইচ্ছার অপব্যবহার — যেমন হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, দুর্নীতি ইত্যাদি।
- প্রাকৃতিক মন্দ (Natural Evil): প্রাকৃতিক নিয়ম ও ঘটনা দ্বারা সংঘটিত দুর্যোগ — যেমন ভূমিকম্প, খরা, বন্যা ইত্যাদি।
এটি স্পষ্টভাবে বুঝে নিতে হবে যে—আল্লাহ সকল কিছুর একমাত্র স্রষ্টা। তিনি যেমন ভালো সৃষ্টি করেন, তেমনি খারাপও — কারণ আল্লাহ যা ইচ্ছা, তাই করেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা যায় না তিনি কেন করলেন।
اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍۢ ۖ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍۢ وَكِيلٌۭ
“আল্লাহ প্রত্যেক কিছুর স্রষ্টা এবং তিনি প্রতিটি বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক।” [সূরা আয-যুমার, ৬২]
আল্লাহর প্রতি আদবের অংশ হলো—আমরা বলি না যে, “আল্লাহ পাপ সৃষ্টি করেন।” বরং আমরা বলি: আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিকে ইচ্ছা ও ক্ষমতা দিয়েছেন, যা তারা ভালো বা খারাপ পথে ব্যবহার করতে পারে।
ٱلَّذِى خَلَقَنِى فَهُوَ يَهْدِينِ
وَٱلَّذِى هُوَ يُطْعِمُنِى وَيَسْقِينِ
وَإِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفِينِ
وَٱلَّذِى يُمِيتُنِى ثُمَّ يُحْيِينِ
“যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই আমাকে পথ দেখান। যিনি আমাকে আহার ও পান করান। আমি যখন অসুস্থ হই, তিনিই আমাকে আরোগ্য দান করেন। যিনি আমাকে মৃত্যু দিবেন এবং পরে আমাকে জীবিত করবেন।” [সূরা আশ-শু’আরা, ৭৮-৮১]
ইব্রাহীম عليه السلام-এর আদব থেকে শিখুন। তিনি সব প্রাকৃতিক ঘটনাকেই আল্লাহর দিকে রুজু করতেন। যদিও আল্লাহ অসুস্থতাকেও সৃষ্টি করেছেন একটি পরীক্ষা হিসেবে, তবুও ইব্রাহীম عليه السلام আদবের কারণে সরাসরি বলেননি যে আল্লাহই তাঁকে অসুস্থ করেন। বরং খুবই বিনয় ও শ্রদ্ধার সাথে তিনি সেটা আল্লাহর দিকে সংযুক্ত করেননি।
আল্লাহ বলেনঃ
أَيْنَمَا تَكُونُوا۟ يُدْرِككُّمُ ٱلْمَوْتُ وَلَوْ كُنتُمْ فِى بُرُوجٍۢ مُّشَيَّدَةٍۢ ۗ وَإِن تُصِبْهُمْ حَسَنَةٌۭ يَقُولُوا۟ هَذِهِۦ مِنْ عِندِ ٱللَّهِ ۖ وَإِن تُصِبْهُمْ سَيِّئَةٌۭ يَقُولُوا۟ هَذِهِۦ مِنْ عِندِكَ ۚ قُلْ كُلٌّۭ مِّنْ عِندِ ٱللَّهِ ۖ فَمَالِ هَٓؤُلَآءِ ٱلْقَوْمِ لَا يَكَادُونَ يَفْقَهُونَ حَدِيثًۭا
مَّآ أَصَابَكَ مِنْ حَسَنَةٍۢ فَمِنَ ٱللَّهِ ۖ وَمَآ أَصَابَكَ مِن سَيِّئَةٍۢ فَمِن نَّفْسِكَ ۚ وَأَرْسَلْنَكَ لِلنَّاسِ رَسُولًۭا ۚ وَكَفَىٰ بِٱللَّهِ شَهِيدًۭا
“তোমরা যেখানে থাকো না কেন, মৃত্যু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই — যদিও তা সুউচ্চ দুর্গে থাকো। যদি তাদের ভালো কিছু ঘটে, তারা বলে: ‘এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে।’ আর যদি কোনো বিপদ আসে, তারা বলে: ‘এটা তোমার (হে মুহাম্মদ ﷺ) পক্ষ থেকে।’ বলো: ‘সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে।’ তাহলে এ জাতির কি হয়েছে যে তারা কোনো কথাই বুঝতে চায় না?” “তোমার কাছে যে ভালো আসে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর তোমার কাছে যে মন্দ আসে, তা তোমার নিজের পক্ষ থেকে। আর আমি তোমাকে মানবজাতির প্রতি রাসূল করে প্রেরণ করেছি। আল্লাহ সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট।” [সূরা আন-নিসা, ৭৮-৭৯]
সব বিপদ-আপদ কেবল আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষেই ঘটে
আল্লাহ বলেনঃ
مَآ أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ إِلَّا بِإِذْنِ ٱللَّهِ ۗ وَمَن يُؤْمِنۢ بِٱللَّهِ يَهْدِ قَلْبَهُۥ ۚ وَٱللَّهُ بِكُلِّ شَىْءٍ عَلِيمٌۭ
“কোনো বিপদ আসে না — কিন্তু তা আল্লাহর অনুমতি ছাড়া নয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহতে ইমান আনে, আল্লাহ তার হৃদয়কে সঠিক পথ দেখান। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।” [সূরা আত-তাগাবুন, ১১]
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: আল্লাহ যা করেন, তার পেছনে একটি মহান হিকমাহ (প্রজ্ঞা) থাকে — তা আমাদের সামনে পরিষ্কার হোক আর না হোক। আমরা তো কেবল একটি “পিক্সেল” পর্যন্তও দেখি না, আর আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণ চিত্র বিদ্যমান।
আল্লাহ বলেনঃ
وَمَا خَلَقْنَا ٱلسَّمَوَتِ وَٱلْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا لَعِبِينَ
مَا خَلَقْنَهُمَآ إِلَّا بِٱلْحَقِّ وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ
“আমি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এ দু’য়ের মাঝে যা কিছু আছে, কিছুতেই খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। আমরা এগুলো সৃষ্টি করেছি যথার্থভাবে, কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না।” [সূরা আদ-দুখান, ৩৮-৩৯]
আল্লাহ হলেন পরম ন্যায়পরায়ণ। জুলুম বা অন্যায় বলতে বোঝায় — কোনো কিছুকে তার প্রকৃত অবস্থান থেকে সরিয়ে ফেলা। আর আল্লাহর নাম ও গুণাবলির দিকে তাকালেই বোঝা যায় — মন্দ, ভুল বা অন্যায়কে তাঁর দিকে সংযুক্ত করা যায় না।
একটুখানি উপলব্ধির জন্য উদাহরণ: উদাহরণ ১:
একজন পিতা নিজ সন্তানের খোলা হৃদযন্ত্রের অস্ত্রোপচারের জন্য সার্জনের কাছে নিয়ে যান। সার্জন শিশুর শরীর “চিরে ও কাটে”। তাহলে কি পিতা ও ডাক্তার মিলে একটি মন্দ কাজ করলেন?না। প্রত্যেক বিবেকবান মানুষ জানে — এ ক্ষণিকের কষ্টের মধ্য দিয়ে পিতা ও সার্জন একটি বড় ক্ষতি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। তারা যদি শিশুকে আগে থেকেই পুরো সার্জারির বিবরণ বলে দিতেন, তাহলে হয়তো ভয়ের কারণে শিশুটি আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতো।
উদাহরণ ২: একজন শিল্পী বিশাল একটি প্রাচীরজুড়ে একটি অসাধারণ চিত্র আঁকলেন। কেউ যদি খুব কাছ থেকে দাঁড়িয়ে শুধু একটি অন্ধকার অংশ দেখে বলে দেয়, “এই চিত্র তো খারাপ,” তাহলে সেটা তো একটা বড় ভুল। সে তো পুরো ছবি দেখতে পারেই না — আর বোঝেও না কেন এই গাঢ় রংগুলো ব্যবহৃত হয়েছে।
এ যদি মানুষের পর্যায়ে এমন হয়, তাহলে খোদ আল্লাহর পর্যায়ে তা কেমন হবে? একজন মানুষ, যে নিজের দেহের কাজকর্মও পুরো বোঝে না, যে জানে না তার রিজিক কীভাবে আসে — সেই মানুষ কি সর্বজ্ঞ, ন্যায়পরায়ণ, পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাবান ও দয়ালু আল্লাহকে প্রশ্ন করতে পারে?
C.S. লুইস বলেন: “কেউ যদি কিছু বক্র মনে করে, তাহলে তার আগে একটি সোজা রেখার ধারণা থাকতে হয়।” তাহলে প্রশ্ন হলো: কে ঠিক করে দেন ভালো কী এবং খারাপ কী? আল্লাহ। কে কোনো বিষয়ে সব দিক থেকে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন? আল্লাহ।
মানব আত্মার সবচেয়ে বড় বিপদগুলোর একটি হলো: অহংকার, আত্মমুগ্ধতা, এবং আত্মতুষ্টি। মানুষ আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রগতির কারণে ভাবে — সে সব কিছু বুঝে ফেলেছে, সব কিছু যাচাই করে নিতে পারে। এরপর মানুষ এমন কিছু দেখলেই বলে দেয়, “এটার কোনো হিকমাহ নেই” — কারণ সে নিজে সেটি বুঝতে পারছে না। কিন্তু আল্লাহ আমাদের তা বলেন না যা আমরা জানতে চাই। তিনি বলেন যা আমাদের জানা দরকার।
পৃথিবীতে কি এমন কিছু আছে যা সম্পূর্ণরূপে মন্দ?
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম رحمه الله লিখেছেন: “একটি এমন মন্দ যা একেবারেই নির্ভেজাল এবং যার মধ্যে কোনো ধরণের ভালো দিক নেই — এমন কিছু এই দুনিয়ায় বিদ্যমান নেই। আমাদের অস্তিত্বে এমন কিছু নেই যাকে সম্পূর্ণ খারাপ বলা যায়, কারণ প্রতিটি খারাপের মধ্যেই কোনো না কোনো ভালো দিক থাকে। যেমন: অসুস্থতা শরীরকে একদিক থেকে ক্ষতি করে ঠিকই, কিন্তু অন্য দিক থেকে তা ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়, মনোবল জাগায় এবং অনেক সময় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও শক্তিশালী করে তোলে। অধিকাংশ অপছন্দনীয় বিষয়ই এমন — যা মানুষের জন্য কিছু না কিছু উপকার বহন করে।” [শিফা আল-আলিল ফি মাসাইল]
আমরা আল্লাহর প্রতি মন্দকে সংযুক্ত করি না। নবী ﷺ বলেন: “সকল কল্যাণ আপনার হাতেই এবং মন্দ আপনার দিকে সংযুক্ত করা যায় না।” [সহীহ মুসলিম]
আল্লাহর সব কাজই কল্যাণপূর্ণ
আল্লাহর যে সকল কাজ তাঁর পক্ষ থেকে সম্পাদিত হয় এবং যেগুলো তাঁর থেকে উদ্ভূত — সেগুলো সবই পরিপূর্ণ ভালো। তার কোনোটির সঙ্গেই মন্দের কোনো সম্পর্ক নেই। কেননা তিনি:
- আল-হাকীম (পরম প্রজ্ঞাবান)
- আল-‘আদল (পরম ন্যায়পরায়ণ)
তাঁর সব কাজেই প্রজ্ঞা ও ন্যায়বিচার রয়েছে। তিনি প্রতিটি কিছুকে তার উপযুক্ত স্থানে রাখেন — যেমনটা তিনি জানেন এবং নির্ধারণ করেন। তাই, তাকদিরে যদি কোনো মন্দ জিনিস থাকে, তা মানুষ বা বান্দার দৃষ্টিকোণ থেকে — যে নিজেই তার অর্জনের কারণে ধ্বংস বা কষ্টের শিকার হয়েছে। আর এইসব কষ্ট বান্দার অর্জনের ফল এবং ন্যায় ও পরিপূর্ণ হিসাব অনুযায়ী ঘটে।
প্রকাশ্য মন্দ ও গোপন হিকমাহ
সূরা আল-কাহফ-এর মধ্যে মূসা ও খিদির عليهما السلام-এর কাহিনী থেকে আমরা বুঝতে পারি যে বেশিরভাগ সময় আমরা আল্লাহর হিকমাহ ও বিচার বুঝে উঠতে পারি না। কিন্তু তা সত্ত্বেও, সেই কাজগুলোর পেছনে মহান উদ্দেশ্য থাকে। এই কাহিনীতে তিনটি ঘটনার হিকমাহ আল্লাহ খিদির عليه السلام-কে জানিয়েছিলেন, তিনি নিজে তা বোঝেননি বা অনুমান করেননি।
ঘটনা ১: নৌকায় গর্ত করা
প্রকাশ্য পরিস্থিতি:
খিদির عليه السلام এমন একটি নৌকায় গর্ত করেন, যা দরিদ্র লোকেরা ব্যবহার করত এবং তারা খিদির ও মূসা عليهما السلام-কে সাহায্য করেছিল। মনে হয়, তাদের উপকারের বদলে ক্ষতি করা হয়েছে।
আল্লাহর হিকমাহ:
নৌকাটি এমন এক গরিব পরিবারে ছিল যাদের ওপর এক জালিম রাজা অত্যাচার চালাচ্ছিল। সে সব ভালো নৌকা দখল করছিল। খিদির عليه السلام নৌকাটিকে সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত করে রক্ষা করলেন যাতে এটি রাজার চোখে না পড়ে, ফলে তারা জীবিকা হারিয়ে না ফেলে এবং দারিদ্র্যে না ডুবে।
ঘটনা ২: এক কিশোরকে হত্যা করা
প্রকাশ্য পরিস্থিতি:
খিদির عليه السلام এমন এক বালককে হত্যা করেন যাকে দেখে মনে হয় সে ছিল নিরীহ — এটা একপ্রকার ঠাণ্ডা মাথায় খুন বলে মনে হতে পারে।
আল্লাহর হিকমাহ:
এই বালক বড় হয়ে একজন অত্যাচারী হত, সে তার মুমিন পিতা-মাতাকে কষ্ট দিত, এমনকি তাদের ইসলাম থেকে সরিয়ে দিত। আল্লাহ খিদির عليه السلام-কে তার ভবিষ্যত জানিয়ে দেন, ফলে সে বালককে তরুণ বয়সেই হত্যা করেন। এতে:
- বালক জান্নাত পাবে কারণ সে নিষ্পাপ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে
- পিতা-মাতা মুসলিম থেকে যাবে এবং পরবর্তীতে ভালো সন্তান লাভ করবে যারা দ্বীনের উপর থাকবে
এইসব ঘটনা প্রমাণ করে — যা কিছু আমাদের দৃষ্টিতে “মন্দ” মনে হয়, তা সবসময় সত্যিকার অর্থে মন্দ না-ও হতে পারে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সীমিত, কিন্তু আল্লাহর জ্ঞান ও হিকমাহ অসীম।
ঘটনা ৩: ইয়াতিম বালকদের দেয়াল মেরামত
বাহ্যিকভাবে দেখা যায়: খিদির একটি প্রাচীর মেরামত করলেন যা ধসে পড়ার মতো অবস্থায় ছিল এমন একটি শহরে, যেখানে মানুষজন তাদের প্রতি কঠোরতা দেখিয়েছিল এবং তাদের দরজাগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল।
আল্লাহর জ্ঞান ও হিকমাহ অনুযায়ী: খিদির যে প্রাচীরটি মেরামত করেছিলেন তা শহরের দুই এতিম ছেলের মালিকানাধীন ছিল। সেই প্রাচীরের নিচে একটি গুপ্ত ধন ছিল। যদি প্রাচীরটি ধসে পড়ত, তবে শহরের খারাপ লোকেরা তা ছিনিয়ে নিত এবং এতিমদের কিছুই অবশিষ্ট থাকত না, কারণ তখন তারা শিশু অবস্থায় ছিল। খিদির প্রাচীরটি মেরামত করে এতিমদের সম্পদ সংরক্ষিত রাখলেন যতক্ষণ না তারা প্রাপ্তবয়স্ক হয় এবং নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে কী করবে ঐ সম্পদের সাথে।
শুধু এজন্য যে আমরা কোনো কিছুর পেছনে হিকমাহ বুঝতে পারি না—যেমন একটি শিশু তার পিতার সিদ্ধান্ত বুঝতে পারে না যখন পিতা তাকে অপারেশনের জন্য রাজি করান—তাতে কি এটা যুক্তিযুক্ত হয় যে আমরা আল্লাহকে প্রশ্ন করি অথবা তাঁর প্রতি সন্দেহ পোষণ করি?
এই বিষয়ে একটি অপূর্ব হাদীসের দিকে তাকান—
উমর ইবনুল খাত্তাব رضي الله عنه বর্ণনা করেন: কিছু বন্দিকে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিকট আনা হলো। তাদের মধ্যে এক নারী ছিল যে (নিজের সন্তান খুঁজতে) দৌড়াদৌড়ি করছিল। যখন সে বন্দীদের মাঝে একটি শিশুকে দেখতে পেল, তখন সে তাকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরল এবং তাকে দুগ্ধ পান করাল। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, “তোমরা কি মনে করো এই নারী কখনো তার সন্তানকে আগুনে নিক্ষেপ করবে?” আমরা বললাম, “আল্লাহর কসম, সে কখনোই তার সন্তানকে আগুনে নিক্ষেপ করবে না।” তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, “নিশ্চয়ই, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি এই নারীর সন্তানের প্রতি দয়াশীলতার চেয়েও অধিক দয়াশীল।” [বুখারি ও মুসলিম]
পৃথিবীতে ব্যক্তির জীবনে, তার সম্পদে বা পরিবারে যেসব বিপদ আসে, সবকিছু আল্লাহর জ্ঞানের মধ্যে আগে থেকেই ছিল এবং সেগুলো আল-লাওহ আল-মাহফূযে (সংরক্ষিত লিপিতে) লেখা হয়েছে। আল্লাহ বলেন:
مَآ أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍۢ فِى ٱلْأَرْضِ وَلَا فِىٓ أَنفُسِكُمْ إِلَّا فِى كِتَبٍۢ مِّن قَبْلِ أَن نَّبْرَأَهَآ ۚ إِنَّ ذَلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرٌۭ
“পৃথিবীতে কিংবা তোমাদের নিজেদের মাঝে কোনো বিপদ আসে না, কিন্তু তা একটা কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে, তা সৃষ্টি করার আগেই—নিশ্চয়ই এটা আল্লাহর জন্য খুবই সহজ।” [সূরা আল-হাদীদ, ২২]
كُلُّ نَفْسٍۢ ذَآئِقَةُ ٱلْمَوْتِ ۗ وَنَبْلُوكُم بِٱلشَّرِّ وَٱلْخَيْرِ فِتْنَةًۭ ۖ وَإِلَيْنَا تُرْجَعُونَ
“প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আর আমি তোমাদেরকে ভালো ও মন্দ দিয়ে পরীক্ষা করি; আর আমার কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।” [সূরা আল-আম্বিয়া, ৩৫]
أَحَسِبَ ٱلنَّاسُ أَن يُتْرَكُوٓا۟ أَن يَقُولُوٓا۟ ءَامَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ
وَلَقَدْ فَتَنَّا ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ ۖ فَلَيَعْلَمَنَّ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ صَدَقُوا۟ وَلَيَعْلَمَنَّ ٱلْكَذِبِينَ
“মানুষ কি মনে করে, তারা শুধু বললেই যে ‘আমরা ইমান এনেছি’ তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হবে, অথচ তারা পরীক্ষা করা হবে না? আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদেরও পরীক্ষা করেছি, এবং আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন কে সত্যবাদী এবং কে মিথ্যাবাদী।” [সূরা আল-আনকাবূত, ২–৩]
প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, সুনামি, মহামারী ইত্যাদিতে যে খারাপ দিক দেখা যায়, আমরা জানি আল্লাহ এগুলোকে একটি উদ্দেশ্য নিয়ে ঘটতে দেন, এবং এর পেছনে অবশ্যই কোনো না কোনো ভালো দিক রয়েছে—তা আমরা প্রত্যক্ষভাবে বুঝি বা না বুঝি। মানবজাতির দ্বারা সংঘটিত অপকর্মগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের বোঝা উচিত, আল্লাহ যখন এই দুনিয়াকে সৃষ্টি করেছেন, তখন তিনি এটিকে খারাপ বা কষ্ট থেকে মুক্ত রাখার উদ্দেশ্যে করেননি। তিনি, পরম মহিমান্বিত, স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে এই জীবন পরীক্ষায় পরিপূর্ণ।
এক ব্যক্তির খারাপ কাজ হয়তো নিজেকে ও তার আশেপাশের কিছু মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা অন্যদের উপকারেও আসতে পারে বা এমন কিছু ভালো পরিণতি ডেকে আনতে পারে যা আমাদের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। প্রতিটি ঘটনার শেষ পরিণতি ভালোই হয়, যতই তা বাহ্যিকভাবে খারাপ বা মন্দ মনে হোক না কেন। কেন? কারণ কোনো বিপদ যদি একজন ব্যক্তিকে আঘাত করে, তবুও সেটি তার জন্য ভালো—সে তা বুঝুক বা না বুঝুক—কারণ আল্লাহ কখনো এমন কিছু নির্ধারণ করেন না যা খারাপ। বরং, এটা অবশ্যই আল্লাহর পূর্ণ ন্যায়বিচার ও হিকমাহর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আল্লাহ বলেন:
قُل لَّن يُصِيبَنَآ إِلَّا مَا كَتَبَ ٱللَّهُ لَنَا هُوَ مَوْلَىٰنَا ۚ وَعَلَى ٱللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ ٱلْمُؤْمِنُونَ
“বলুন: আমাদেরকে কিছুই আঘাত করতে পারে না, তবে যা আল্লাহ আমাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন। তিনিই আমাদের অভিভাবক। আর আল্লাহর ওপরই ইমানদারগণ ভরসা করুক।” [সূরা আত-তাওবা, ৫১]
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “নিশ্চয়ই, আল্লাহ একজন মু’মিনের জন্য যা কিছু নির্ধারণ করেন, তাতে শুধু কল্যাণই থাকে।” [আহমদ]
আল্লাহ আরও বলেন:
ظَهَرَ ٱلْفَسَادُ فِى ٱلْبَرِّ وَٱلْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِى ٱلنَّاسِ لِيُذِيقَهُم بَعْضَ ٱلَّذِى عَمِلُوا۟ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
“ভূমিতে ও সাগরে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের কৃতকর্মের কারণে—যাতে তিনি তাদেরকে তাদের কিছু কৃতকর্মের স্বাদ আস্বাদন করান—যেন তারা (সঠিক পথে) ফিরে আসে।” [সূরা আর-রূম, ৪১]
এখানে আমরা দেখি যে, বিপর্যয় বা দুর্নীতি একটি খারাপ বিষয়—যা মানুষের কাজের ফল। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর মধ্যেও একটি চূড়ান্ত কল্যাণ নিহিত রয়েছে—মানুষ যেন ফিরে আসে আল্লাহর পথে। কোনো বিপর্যয়ই আল্লাহর অনুমতি ছাড়া ঘটে না। যদি আল্লাহ না চাইতেন, তা ঘটত না। কিন্তু আল্লাহ তা ঘটতে দিয়েছেন এবং নির্ধারণ করেছেন, তাই তা ঘটেছে। এবং প্রতিটি ঘটনায় অবশ্যই কিছু না কিছু ভালো দিক থাকে। আল্লাহ বলেন:
مَآ أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ إِلَّا بِإِذْنِ ٱللَّهِ ۗ وَمَن يُؤْمِنۢ بِٱللَّهِ يَهْدِ قَلْبَهُۥ ۚ وَٱللَّهُ بِكُلِّ شَىْءٍ عَلِيمٌۭ
“আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনো বিপদ আসে না । আর যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ইমান আনে, আল্লাহ তার অন্তরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন। আল্লাহ সব কিছু ভালোভাবেই জানেন।” [সূরা আত-তাগাবুন, ১১]
ইমাম ইবনু কাসির رحمه الله এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন—এর অর্থ হলো, যে ব্যক্তি জানে যে বিপদ আল্লাহর হুকুম ও তাকদির অনুযায়ী এসেছে, এবং সে ধৈর্য সহকারে আল্লাহর প্রতিদান প্রত্যাশা করে, আল্লাহ তার অন্তরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন এবং ইমানে দৃঢ়তা দান করেন। আল্লাহ তার ক্ষতিপূরণ এই দুনিয়াতেই দিতে পারেন—সমরূপ বা তার চেয়েও উত্তম কিছু দিয়ে। [তাফসির ইবন কাসির]
যখন কেউ এই বিশ্বাসে পৌঁছায় যে সব বিপদই আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্ধারণ অনুযায়ী ঘটে, তখন তার করণীয় হলো—ইমান রাখা, অটল থাকা এবং ধৈর্য ধারণ করা। আর ধৈর্যের প্রতিদান হলো জান্নাত। আল্লাহ বলেন: “আর তিনি তাদেরকে তাদের ধৈর্যের কারণে জান্নাত ও রেশমী পোশাক দ্বারা পুরস্কৃত করবেন।” [সূরা আল-ইনসান, ১২]
যখন মানুষ যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে মারা যায়, তখন মৃত ব্যক্তি তিন শ্রেণির মধ্যে একজন হয়ে থাকেন:
প্রথমত: তিনি যদি একজন নিবেদিতপ্রাণ ধার্মিক ব্যক্তি হন, তবে এটি তার জন্য মৃত্যুর সর্বোত্তম সময়। আল্লাহ জানতেন, যদি তিনি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতেন, তাহলে হয়তো তিনি এমন ভালো ও ধার্মিক অবস্থায় থাকতেন না যেমন অবস্থায় তিনি মারা গেছেন। তাই আল্লাহ চেয়েছেন তিনি তাঁর ইমানের সর্বোচ্চ অবস্থায় মারা যান। এছাড়াও, যেকোনো কষ্ট যা তার উপর আসে এবং তিনি ধৈর্য ধারণ করেন, আল্লাহ তা তাঁর পাপের কাফফারা হিসেবে পরিগণিত করেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “এমন কোনো বিপদ একজন মুসলিমকে আঘাত করে না, যার ফলে আল্লাহ তার কিছু পাপ মোচন করে দেন না, এমনকি একটি কাঁটার খোঁচার জন্য বান্দার গুনাহ ক্ষমা করা হয়।” [বুখারি]
দ্বিতীয়ত: তিনি এমন একজন মুসলিম হতে পারেন যিনি গুনাহে নিমজ্জিত ছিলেন এবং আল্লাহ জানেন যে তিনি যদি আরো বেঁচে থাকতেন তবে আরও অধঃপতিত হতেন। সুতরাং, এই সময়েই তাঁর মৃত্যু হওয়া উত্তম যাতে তিনি কম গুনাহ নিয়ে আল্লাহর সামনে হাজির হন।
তৃতীয়ত: তিনি একজন কাফির বা অপবিত্র ব্যক্তি হতে পারেন এবং আল্লাহ জানেন যে যদি তিনি বেঁচে থাকতেন, তবে তিনি ভালো হতেন না। তাই তাঁর মৃত্যু সমাজকে তাঁর শারীরিক ও নৈতিক অনিষ্ট থেকে মুক্তি দেয়। এই সবকিছু আমরা সূরা আল-কাহফে মুসা আলাইহিস সালাম ও খিদির عليهما السلام -এর ঘটনার মধ্যেই দেখতে পাই, যেমনটি উপরে আলোচিত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “এই দুনিয়ার জীবনের উদাহরণ আখিরাতের তুলনায় এমন, যেন তোমাদের কেউ তার আঙুল সাগরে ডুবিয়ে দেয়; সে যেন দেখে কী নিয়ে সেটি ফিরে আসে।” [মুসলিম]
আমাদের চারপাশে যে সকল কষ্টকর দৃশ্য দেখা যায়—বিপর্যয়, নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা, এবং আরও অনেক কিছু—এসব দেখে অনেকেই বলে বসে: “জীবন অবিচারপূর্ণ।” এই বক্তব্য কেবল তখনই যৌক্তিক হতো যদি কিয়ামতের দিন না থাকত—যেদিন সকল পাপীর বিচার হবে, এবং যদি আখিরাত না থাকত—যেখানে পরীক্ষিতদের প্রতিদান দেওয়া হবে। কিন্তু নিশ্চয়ই আল্লাহ পরম ন্যায়পরায়ণ।
শিশুদের হত্যায় কী কল্যাণ থাকতে পারে? আমরা খিদিরের কাহিনীতে দেখেছি, একটি শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা বাহ্যিকভাবে যতই খারাপ মনে হোক, প্রকৃতপক্ষে তা ছিল সেই শিশু ও তার পরিবার উভয়ের জন্যই কল্যাণকর।
আল্লাহর অগাধ হিকমতের মাঝে আরেকটি দৃষ্টিকোণ এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, যেখানে রাসূল ﷺ বলেন:
“কিয়ামতের দিন শিশুদেরকে বলা হবে: জান্নাতে প্রবেশ কর। তারা বলবে: হে আমাদের প্রতিপালক! (আমরা প্রবেশ করব না) যতক্ষণ না আমাদের পিতা-মাতাও প্রবেশ করে। তখন আল্লাহ বলবেন: আমি দেখি কেন তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে দ্বিধা করছে? তারা বলবে: হে আল্লাহ! আমাদের পিতা-মাতা। তখন আল্লাহ বলবেন: তোমরা সবাই জান্নাতে প্রবেশ কর—তোমরাও এবং তোমাদের পিতামাতাও।” [আহমদ]
এই ‘অকাল’ ও ‘অবিচারপূর্ণ’ মৃত্যু পরিণত হয়েছে শুধুমাত্র শিশুর নয়, তার পিতামাতার জন্যও চিরন্তন মুক্তির উপায়ে। এই শিশুদের পরিণতি কী হবে যারা দুনিয়ায় মারা গেছে? নিশ্চয়ই আল্লাহ পরম ন্যায়পরায়ণ ও সর্বজ্ঞ। আয়েশা رضي الله عنها বলেন: রাসূলুল্লাহ ﷺ আনসারদের একটি শিশুর জানাজার জন্য আহ্বান জানানো হলে আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল! তাকে জান্নাতের পাখিদের একজন হিসেবে সুসংবাদ দিন, সে কোনো পাপ করেনি, না পাপ তাকে স্পর্শ করেছে। তিনি জবাব দিলেন: “ওটা সে নয়, হে আয়েশা। নিশ্চয়ই আল্লাহ কিছু মানুষকে জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করেছেন তারা যখন পিতার পৃষ্ঠে ছিল, আর কিছু মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছেন তারা যখন পিতার পৃষ্ঠে ছিল।” [মুসলিম]
আল্লাহ কাউকে তাঁর ভবিষ্যতের জ্ঞান অনুযায়ী বিচার করবেন না যতক্ষণ না সে কাজটি বাস্তবে করে। সেটি অন্যায় হতো। আল্লাহ প্রত্যেককে সুবিচার ও সমান সুযোগ দেন নিজেকে প্রমাণ বা অপ্রমাণ করার। যাদের এই দুনিয়ায় যথাযথ সুযোগ মেলেনি, তাদেরকে আখিরাতে সেই সুযোগ দেওয়া হবে এবং তখনই তাদের বিচার করা হবে।
বুখারির দীর্ঘ হাদীসে উল্লেখ আছে—যেসব শিশু বালেগ হওয়ার আগেই মারা গেছে, তারা বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসীর সন্তান হোক, সবাই বারযাখে একটি সাময়িক জান্নাতে থাকবে। কিয়ামতের দিন তাদের পরীক্ষা করা হবে, তারপর তাদের স্থান নির্ধারিত হবে—জান্নাত বা জাহান্নাম।
সারসংক্ষেপে বলা যায়:
- প্রকৃত ‘মন্দ’ বলে কিছু নেই।
- মানুষ পূর্ণ স্বাধীনতা রাখে—সে মন্দ কাজ করবে কি করবে না।
- ‘মন্দ’ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন যাতে মানুষ নিজেকে রক্ষা করতে পারে, এবং ভালো কাজ চিনে তা বাস্তবায়ন করতে পারে।
- যেটাকে আমরা ‘মন্দ’ মনে করি, তা আসলে দীর্ঘমেয়াদে খারাপ নাও হতে পারে।
- কিছু ‘মন্দ’ অপরিহার্য যাতে সৃষ্টিজগৎ বিনয়ী হয় এবং আল্লাহকে চিনে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
- কিছু ‘মন্দ’ দরকার যাতে কল্যাণের বিশালতা প্রকাশ পায়।
- কিছু ‘মন্দ’ দরকার যাতে মানুষকে পরীক্ষা করা যায়, কিংবা বাস্তবতা উপলব্ধির জন্য তাদেরকে জাগিয়ে তোলা যায়।
- কিছু ‘মন্দ’ দরকার যাতে গুনাহ মাফ হয় বা মর্যাদা উন্নীত হয়।
- কিছু ‘মন্দ’ দরকার যাতে মু’মিন ও কাফির আলাদা হয়ে যায়।
- জীবনের প্রকৃতি, উদ্দেশ্য, কিয়ামতের গুরুত্ব এবং আখিরাতের জীবন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখলে ‘মন্দ’ সংক্রান্ত সন্দেহ দূর হয়।
পরিশেষে
থামুন। ভাবুন। আজই পরিবর্তনের পথে হাঁটা শুরু করুন। পড়ুন:
- ইসলামের ভিত্তিগুলো কী? আল্লাহ আমাদের কাছে কী চান?
- রিবা কী? আপনার মৌলিক জ্ঞান মজবুত করুন এবং রিবার অর্থ থেকে আপনার উপার্জনকে পরিশুদ্ধ করুন—তা সদকা দিয়ে দিন।
- যাকাত কী? আপনার মৌলিক জ্ঞান মজবুত করুন এবং নিশ্চিত করুন যে আপনি আপনার উপর ফরজ হওয়া সকল যাকাত প্রদান করেছেন।
- আমাদের লেনদেন কীভাবে হচ্ছে এবং কীভাবে সেগুলোতে রিবা এড়ানো যায়?
- কীভাবে মানুষ এবং দেশসমূহ ঋণের দাসত্বে পতিত হচ্ছে এবং এই ঋণ কীভাবে তৈরি হয়?
- কীভাবে মুদ্রাস্ফীতি আমাদের সম্পদকে নিঃশেষ করছে এবং হালাল বিনিয়োগের কী কী বিকল্প আছে?
- কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্পর্কে পড়ুন এবং কীভাবে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড তুলে নেওয়া হয়েছে তা জানুন।
- বিটকয়েন সম্পর্কে জানুন—রিবা-নির্ভর ব্যবস্থার বাইরে বেরিয়ে আসার একটি সম্ভাব্য সুযোগ হিসেবে; পাশাপাশি অন্যান্য ক্রিপ্টো ও অল্ট কয়েনের বিপদও বোঝার চেষ্টা করুন।
আমরা মুসলিমরা অনেক সময় রিবা বিষয়টিকে হালকাভাবে নিই—যেমন আমরা মদের বা হারাম মাংসের বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দিই, তেমনভাবে একে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না। কারণ এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সরাসরি দৃশ্যমান নয়—যদিও আমরা এর দ্বারা ঘিরে আছি, বিভিন্ন নাম, গোপন পরিভাষা ও চতুর ব্যবস্থার মাধ্যমে। কিন্তু এটি হালকাভাবে নেওয়ার মত বিষয় নয়। এটি আমাদের ঠিক তেমনই হৃদয়ে ধারণ করতে হবে যেমন আমরা সূরা আল-ফাতিহাকে ধারণ করি—শরিয়তে রিবার প্রতি শূন্য সহনশীলতা (zero tolerance) আছে। এটি এমন একটি বিষয় যার ব্যাপারে আল্লাহ কঠোর ভাষায় কথা বলেছেন। আল্লাহ কখনো কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেননি—কেবল রিবার ব্যাপার ছাড়া।
এ প্রসঙ্গে আমাদের এক শিক্ষকের একটা মজার কিন্তু গভীর কথা মনে পড়ছে। শাইখ ড. শুয়াইব ওয়ানী বলেছিলেন:
“হারামের বিভিন্ন স্তর আছে। কিছু হারাম অন্যগুলোর তুলনায় বেশি কঠিন। উদাহরণস্বরূপ: যদি তোমার সামনে মাত্র দুটি অপশন থাকে—রিবা খাওয়া বা শূকর খাওয়া—তাহলে ‘শূকরের বিরিয়ানি’ খাও।”
সন্দেহজনক বিষয়ে আমাদের উলামাদের জিজ্ঞাসা করা উচিত। ব্যবসা করছি বা কোনো বিনিয়োগে যাচ্ছি—তাহলে আমাদের উচিত একজন আলেমকে সবকিছু খুলে বলা এবং এরপরই পদক্ষেপ নেওয়া। আমাদের উচিত সত্যটা পুরোপুরি বলা—আংশিক কিছু বলে শুধু শরিয়া কমপ্লায়েন্ট সিলমোহর পাওয়ার জন্য নয়। আমরা যদি সত্য গোপন করে ফতোয়া নিই, তাহলে উলামারা তাদের দায়িত্ব পালন করবেন, কিন্তু দিন শেষে জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হতে হবে আমাদেরকেই। আমরা যেন এমন না হই যে, প্রচুর লাভ করে ফেলেছি এবং এখন বুঝতে পারছি এতে রিবা ছিল—তখন আবার কিছু ‘চালাকি’ করে তা হালাল করার চেষ্টা করছি। শরিয়াহ বোর্ড বা আলেমদের ‘চিফ লুপহোল অফিসার‘ বানিয়ে ফেলা যাবে না। প্রচুর আয় করাও ভালো—এমনকি এটি উৎসাহিত—কারণ আল্লাহ শক্তিশালী মু’মিনকে ভালোবাসেন। সমস্যা হলো, সেই আয় যদি আসে হারাম উৎস থেকে।
মনে রাখুন! হারাম উৎস থেকে যা কিছু উপার্জিত হয়, তা যত বড়ই হোক, তা একদিন নিশ্চয়ই হারিয়ে যাবে বা ক্ষতি বয়ে আনবে। রিবা যুক্ত লেনদেনে বরকত উঠিয়ে নেওয়া হয়। যে রিবা নেয়, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এমন কে আছে যে এই যুদ্ধে জিতবে? কেউ না। যদি আল্লাহ আমাদের সাহায্য না করেন, তবে আল্লাহ আমাদেরকে আমাদের কাজের মাধ্যমেই ধ্বংস হতে দেবেন।
চলুন আমরা একটি ঘটনা পড়ি যা আলস্য, বিলাসিতায় গা ভাসানো, নিজের ভুল স্বীকার, সংশোধনের চেষ্টা, এবং মানসিক স্বাস্থ্য—এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে শেখায়।
রাসূলুল্লাহ ﷺ এর জীবনী থেকে আমরা জানি—তাবুক যুদ্ধ চলাকালে তিনজন সাহাবি বৈধ ওজর ছাড়াই পিছিয়ে ছিলেন। তারা হলেন: কাব ইবন মালিক, মুরারাহ ইবন রাবিʿ, এবং হিলাল ইবন উমাইয়্যাহ رضي الله عنهم।
তাদের শাস্তিস্বরূপ ৫০ দিন পর্যন্ত সমাজ তাদেরকে বয়কট করে। তারা প্রতিদিনের নামাজে মসজিদে যেতেন, বাজারে যেতেন, কিন্তু কেউ তাদের সঙ্গে কথা বলত না বা সম্পর্ক রাখত না। এমনকি তাদের নিজ পরিবারের সদস্যরাও না।
এই ঘটনায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা:
১. এই সাহাবিরা সবাই রাসূল ﷺ এর কাছে সত্য কথা বলেছিলেন। কেন তারা পিছিয়ে ছিলেন, তা নিয়ে মিথ্যা বলেননি। এখান থেকে আমরা শিখি, যদি আমরা কোনো ভুল করি—তবে সেটিকে স্বীকার করে নিতে হবে, বাহানা না বানিয়ে। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। মিথ্যা বলা কোনো সমাধান নয়—কারণ শেষ পর্যন্ত সেটা আমাদেরই ক্ষতিই করে।
২. কা’ব ইবনে মালিক (Kaʿb ibn Mālik) তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময়ই দরিদ্র ছিলেন এবং আহলে সুফফা (Ahl as-Suffah)-র অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। যেসময় যুদ্ধের ডাক আসে তখনই তিনি প্রথমবারের মতো তিনি কিছু অর্থ উপার্জন করতে শুরু করেন। তাঁর তখন দুটি উট ছিল এবং কিছু জমিও ছিল। এই সমস্ত কিছু ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টি তাঁকে দ্বিধায় ফেলে দেয় বা হয়ত এই সম্পদের কারণে তিনি একটু মনোযোগ হারিয়ে ফেলেন। এখান থেকে আমরা শিখি—যদি আমরা আমাদের সম্পদের সাথে সম্পর্ককে সঠিকভাবে বুঝে তা ঠিক না করি, তাহলে এটি আমাদের জন্য অনুগ্রহ না হয়ে অভিশাপ হয়ে উঠতে পারে। সম্পদ আমাদের জন্য লক্ষ্যে পৌঁছার উপায় হওয়া উচিত, লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়।
৩. তিনি পিছিয়ে পড়েছিলেন এবং দেরি করতে করতে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন যে তিনি রাসূল ﷺ-এর সফরে অংশগ্রহণ এবং আল্লাহকে খুশি করার সুযোগ হারিয়ে ফেলেন। এখান থেকে আমরা সময় ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব এবং নির্ধারিত সময়ে কাজ সম্পাদনের অপরিহার্যতা শিখি। যে সুযোগ আমরা আজ হাতছাড়া করলাম, তা হয়ত আর কখনও ফিরে আসবে না। এমনকি ৪০ বছর পর যখন কা’ব তাঁর সন্তানকে ঘটনাটি বলছিলেন, তখনও তিনি রাসূল ﷺ -এর সাথে সফরে না থাকতে পারার জন্য গভীর অনুশোচনা প্রকাশ করেন।
৪. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি যা আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে, সেটি এই বয়কট বা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতা। আজকের প্রেক্ষাপটে দেখলে, যেমন ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’, প্রযুক্তিতে আসক্তি, বিদেশে পড়াশোনা বা কাজ করা—আমরা নিজেরাই নিজের উপর একটা নিরব বয়কট চাপিয়ে দিচ্ছি, তা বুঝতেই পারছি না। এমনকি মানুষের ভিড়ে থাকলেও দিন যায় কারও সাথে শারীরিকভাবে কোনো কথা না বলেই। এখান থেকে আমরা বুঝি—সামাজিক সম্পৃক্ততা, জামাআতে সালাত এবং ইলমের মজলিসে অংশগ্রহণ কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তদ্রূপ, পরিবার ও বন্ধুদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা কতটা জরুরি। বহু মানুষ বলে যে তারা রিবা এবং যাকাত সম্পর্কে কিছুই জানত না। এই সামাজিক সংযোগ এই অজ্ঞানতা দূর করতে সহায়ক হতে পারে। একজন ব্যক্তি যদি তাঁর কমিউনিটিতে সক্রিয় থাকেন, তবে তাঁর পক্ষে রিবা, যাকাত ইত্যাদির আলোচনা এড়িয়ে চলা প্রায় অসম্ভব। তাই আজ থেকেই পরিবর্তন শুরু করুন, ইনশা’আল্লাহ।
আমরা সবাই রাসূল ﷺ-এর তাঁর প্রিয় সাথী আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-কে দেওয়া বিখ্যাত নসিহত শুনেছি—
لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا — “বিষণ্ণ হইও না; নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।” আমরা এটি ইন্সটাগ্রামসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় বারবার দেখতে পাই। কিন্তু একে আরও সুন্দর করে তোলে যখন আমরা বুঝি, এই বাক্যটি ঠিক কোন পরিস্থিতিতে নাযিল হয়েছিল—
১. মুসলমানদের কেবল ইসলাম গ্রহণ করার কারণে কঠোর নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছিল।
২. রাসূল ﷺ-এর ঘরে কুরাইশদের ১১ জন সদস্য তাঁকে হত্যা করার জন্য হামলা করেছিল।
৩. মক্কার প্রতিটি নির্গমন পথ ছিল সশস্ত্র পাহারায় ঘেরা।
৪. তাঁদের মাথার উপর ছিল ১০০ উটের পুরস্কার ঘোষণা।
৫. তাঁদের খাবার রেশন ছিল সীমিত।
৬. গারে সাওর-এ আবু বকর (রা.)-কে বিষধর বিছে দংশন করেছিল।
৭. একজন ঘাতক তাঁদের প্রায় কাছে পৌঁছে গিয়েছিল—মাত্র কয়েক মিটার দূরে।
এই পবিত্র শব্দগুলো কেবল ভালো লাগার বাক্য নয়। বরং এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে সব মু’মিনদের জন্য একটি প্রতিশ্রুতি, যারা তাঁদের সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যায় এবং পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করে। আরবের সবচেয়ে শক্তিশালী গোত্রও দুইজন ব্যক্তিকে থামাতে পারেনি, কারণ তাঁদের তৃতীয় ছিলেন আল্লাহ। আমরা যদি আমাদের কষ্ট ও দুশ্চিন্তাগুলো হিজরার প্রেক্ষাপটের পাশে রাখি, তাহলে আমরা ইমানের তীব্র জাগরণ অনুভব করি। যদি আল্লাহ তাঁদের সাহায্য করে থাকেন, তবে আমাদের সমস্যাগুলো তো একটি মাছির ডানার সমানও নয়। পুরো আয়াতটি পড়ুন এবং নিশ্চিত থাকুন—
إِلَّا تَنصُرُوهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللَّهُ إِذْ أَخْرَجَهُ الَّذِينَ كَفَرُوا ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا فَأَنزَلَ اللَّهُ سَكِينَتَهُ عَلَيْهِ وَأَيَّدَهُ بِجُنُودٍ لَّمْ تَرَوْهَا وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِينَ كَفَرُوا السُّفْلَىٰ وَكَلِمَةَ اللَّهِ هِيَ الْعُلْيَا وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
“যদি তোমরা তাকে (রাসূলুল্লাহকে) সাহায্য না কর তাহলে আল্লাহই তাকে সাহায্য করবেন যেমন তিনি তাকে সাহায্য করেছিলেন সেই সময়ে যখন কাফিরেরা তাকে দেশান্তর করেছিল, যখন দু’জনের মধ্যে একজন ছিল সে, যে সময় উভয়ে গুহার মধ্যে ছিল, যখন সে স্বীয় সঙ্গীকে (আবূ বাকরকে) বলেছিলঃ তুমি বিষণ্ণ হয়োনা, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। অতঃপর আল্লাহ তার প্রতি স্বীয় প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাকে শক্তিশালী করলেন এমন সেনাদল দ্বারা যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি এবং আল্লাহ কাফিরদের বাক্য নীচু করে দিলেন, আর আল্লাহর বাণী সমুচ্চ রইল, আর আল্লাহ হচ্ছেন প্রবল প্রজ্ঞাময়।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত ৪০]
একইভাবে বদর-এ দেখা যায়, মাত্র ৩১৩ জন সঙ্গী, যারা পর্যাপ্ত প্রস্তুতও ছিল না, তারা কুরাইশের শক্তিশালী ১০০০ জনের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে। কুরাইশ, যারা একসময় আরবের গর্ব ছিল, তারা পরাজিত হয় একদল ক্ষুদ্র বিদ্রোহীদের দ্বারা। সংখ্যা খুব কম ক্ষেত্রেই মুসলিমদের পক্ষে ছিল। এটি প্রমাণ করে যে, এটি সংখ্যার ব্যাপার নয়, বরং মানের ব্যাপার। এতো ছোট একটি দল কীভাবে বিশাল শত্রুকে পরাজিত করলো? তাওয়াক্কুলের কারণে। আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ ভরসা, নিখাদ নিয়্যাত, এবং রাসূল ﷺ-এর নির্দেশাবলির প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য। তাঁরা প্রচেষ্টার সাথে হারাকাহ করতেন যাতে বারাকাহ আসে। কারণ আমাদের শিখানো হয়েছে—উট বেঁধে তারপর তাওয়াক্কুল করতে হয়।
এর বিপরীতে আজ আমরা—সংখ্যায় অনেক, কিন্তু গুণমানে অপ্রতুল; নিজের দায়িত্ব এড়াতে ফাঁকফোকর খুঁজতে ব্যস্ত। আমাদের উস্তাদ শায়খ ড. সাজিদ উমর হাফিযাহুল্লাহ বলেন, আজও, হ্যাঁ আজও, যদি কেউ নিঃস্বার্থভাবে আন্তরিক নিয়্যাতে কাজ শুরু করে এবং কেবল আল্লাহর সাহায্যের উপর নির্ভর করে, তবে আল্লাহ তাঁর অশেষ রহমতে ফেরেশতাদের পাঠাবেন তাঁর সাহায্যে। তাই সাহস হারাবেন না, বরং “বিষণ্ন হবেন না; নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।” শায়খ সাফিউর রহমান মুবারকপুরী رحمه الله ‘আর-রাহীকুল মাখতূম’-এ তাইফ-এ রাসূল ﷺ-এর দোয়ার বর্ণনা করেন। তিনি তখন তাঁর সবচেয়ে কাছের আত্মীয়দের হারিয়েছেন, মক্কা থেকে বিতাড়িত, তাইফবাসীর দ্বারা পাথর নিক্ষিপ্ত এবং তার বার্তা প্রত্যাখ্যাত। তখন তিনি বলেছিলেন—
اَللُّهُمَّ اِلَيْكَ اَشْكُوْ ضَعْفَ قُوَّتِي، وَقِلَّةَ حِيْلَتِيْ وَهَوَانِيْ عَلَى النَّاسِ يَا اَرْحَمَ الرَّاحِمِيْنَ، اَنْتَ رَبُّ الْمُسْتَضْعَفِيْنَ، وَاَنْتَ رَبِّي، اِلَى مَنْ تَكِلُّنِيْ اِلَى بَعِيْدٍ يَتَجَهَّمُنِيْ ؟ اَوْ اِلَى عَدُوٍّ مَلَكْتَهُ اَمْرِيْ ؟ اِنْ لَمْ يَكُنْ بِكَ غَضَبٌ عَلَيَّ فَلاَ اُبَالِيْ وَلَكِنْ عَافِيَتَكَ هِيَ اَوْسَعُ لِيْ، أَعُوْذُ بِنُوْرِوَجْهِكَ الَّذِيْ اَشْرَقَتْ بِهِ الظُّلُمَاتُ، وَصَلُحَ عَلَيْهِ اَمْرُ الدُّنْيَا وَاْلاَخِرَةِ مِنْ اَنْ تُنَزِّلَ بِي غَضَبُكَ اَوْ تَحُلُّ بِي سَخَطُكَ، لَكَ الْعَتْبَي حَتَّى تَرْضَي، وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ اِلاَّبِكَ
“হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে অভিযোগ করছি আমার শক্তির দুর্বলতা, আমার কৌশলের অভাব এবং মানুষের সামনে আমার তুচ্ছতা সম্পর্কে। হে সবচেয়ে দয়ালু! তুমি দুর্বলদের রব, তুমিই আমার রব! তুমি আমাকে কার হাতে ছেড়ে দিয়েছো? এমন একজনের হাতে, যে আমাকে অবজ্ঞা করে? নাকি এমন এক শত্রুর হাতে, যাকে তুমি আমার ওপর কর্তৃত্ব দিয়েছো? যদি তুমি আমার ওপর রাগান্বিত না হও, তবে আমি কিছুই পরোয়া করি না। তবুও, তোমার আরাম ও নিরাপত্তাই আমার জন্য প্রশস্ততর। আমি তোমার চেহারার সেই নূরের আশ্রয় চাই, যার দ্বারা সমস্ত অন্ধকার দূর হয় এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সব কিছু সঠিকভাবে চলতে পারে, যাতে তোমার রাগ বা অসন্তোষ আমার উপর না আসে। আমি তোমার সন্তুষ্টি কামনা করি যতক্ষণ না তুমি সন্তুষ্ট হও। আর কোনো ক্ষমতা বা শক্তি নেই তোমার সাহায্য ছাড়া।”
ইয়া রব! আমাদের কথা আর কাজের মাঝে কোনো মিল নেই। উভয়ই আজ নিষ্প্রভ। আমরা কেবল তোমার দিকেই হাত তুলে প্রার্থনা করি, কারণ তুমি ছাড়া কেউ কখনও সাহায্য করতে পারেনি, পারবে না। উম্মাহর ভবিষ্যৎ আজ আমাদের চোখের সামনে হত্যা করা হচ্ছে, অথচ আমরা নীরব। পুরুষেরা চলে গেছে, এখন কেবল নরীরা রয়ে গেছে।
দু’আ – চিরকাল মুসলমানদের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র ছিল, আছে এবং থাকবে। আমাদের রব সেই একই রব, যিনি মূসা আ.-কে সাহায্য করেছিলেন যখন পেছনে ফেরাউনের বাহিনী আর সামনে লাল সাগর। তখন সব কিছু হারিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায়ও তিনি আল্লাহর উপর ভরসা করে চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। তুমি যেভাবে পারো, যতটুকু পারো চেষ্টা করো। ছোট ছোট পাথর দিয়েই তো শুরু হয় পাহাড় ধস। আল্লাহর কসম, ঠিক এমন সময়েই মানুষ সত্যিকার অর্থে আল্লাহর কদর উপলব্ধি করে। আল্লাহ – ইনসাফকারী, বাদশাহদের বাদশাহ। আজ যারা নিজেদের “রাজা”, “শাসক”, “ক্ষমতাবান” ভাবছে, তারা মনে করে তারা যা খুশি তাই করতে পারে। কিন্তু আল-মালিক, আল-আদল তাদের প্রতিটি ফোঁটা রক্তের হিসাব নেবেন। আল্লাহ ফেরাউনের অনুরূপ এবং তাদের দোসরদের কঠিন শাস্তি দিন।
ফুটনোট: [১] ইনাহ অর্থ বাকি।কেউ তার কোনো পণ্য অপরের কাছে বাকিতে বিক্রি করে ক্রেতার হাতে পণ্য তুলে দিল। তারপর সে মূল্য পরিশোধের আগেই তার (ক্রেতার) কাছ থেকে বিক্রেতা ওই একই পণ্য নগদ মূল্যে কিনে নিল তার চেয়ে কম মূল্যে। যেহেতু দুই দফা বেচাকেনা হয়ে থাকে যার একটি হয় নগদ আর অপরটি হয় বাকিতে, এই কারণে একে বাইয়ে ইনাহ বলা হয়। ইসলামি শরিয়তে বাইয়ে ইনাহ জায়েয নেই। কারণ এতে ঋণ দিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা গ্রহণ করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।
No Comment! Be the first one.