যয়দ ইবনে সাবিত رضي الله عنه বলেছেন যে, নবী ﷺ বলেছিলেন, “আল-শাম কত বরকতপূর্ণ!” সাহাবারা জিজ্ঞেস করেন, “কেন?” রাসুল ﷺ উত্তর দেন, “আমি দেখছি আল্লাহর ফেরেশতারা আল-শামের উপর তাদের ডানা প্রসারিত করছেন।”
[তিরমিজি]
মাসজিদ আল-আকসা হলো ইসলামী বিশ্বের তিনটি প্রধান মসজিদের একটি। এটি মক্কার মাসজিদ আল-হারাম এবং মদিনার মসজিদে নববির পরে তৃতীয় স্থান লাভ করেছে। মসজিদ আল হারাম ব্যতিত আল আকসা কুরআনে উল্লেখিত একমাত্র মসজিদের নাম। এটি ছিল মুসলমানদের প্রথম কিবলা। রাসুলুল্লাহ ﷺ তাঁর জীবনের একটি বড় অংশে, কিবলা পরিবর্তনের আগ পর্যন্ত, কা‘বা শরীফের চেয়ে বেশি সময় মাসজিদ আল-আকসার দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেছেন।
আল-আকসা বা কুদসের পবিত্র ভূমি খ্রিস্টান ও ইয়াহুদিদের কাছে যেরুজালেম নামে পরিচিত। এই ভূমিকে তাদের ধর্মে পবিত্র ও বরকতময় মনে করা হয়। এটি ছিল আল্লাহর নবীদের ভূমি عليهم السلام। তাছাড়া, তিন ধর্মই বিশ্বাস করে যে, এখানেই সেসব ঘটনার সূত্রপাত হবে যা পৃথিবীকে শেষ সময়ের দিকে নিয়ে যাবে।
আল-কুদস বৃহত্তর শামের (the Lavent) কেন্দ্রভূমি, যা সমকালীন সিরিয়া, ফিলিস্তিন, জর্ডান, লেবানন, উত্তর পূর্ব মিশর, দক্ষিণ পশ্চিম তুরস্ক, উত্তর পশ্চিম সৌদির কিছু অংশ এবং আশপাশের অন্যান্য এলাকা সমন্বিত। আল্লাহ কেয়ামত পর্যন্ত জেরুজালেম ও আল-আকসা এর কথা স্মরণীয় করে রেখেছেন, তিনি আমাদের বলেছেন,
سُبْحَـٰنَ ٱلَّذِىٓ أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِۦ لَيْلًۭا مّ مَّنَ ٱلْمَسْجِدِ ٱلْحَرَامِ إِلَى ٱلْمَسْجِدِ ٱلْأَقْصَا ٱلَّذِى بَـٰرَكْنَا حَوْلَهُۥ لِنُرِيَهُۥ مِنْ ءَايَـٰتِنَآ ۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلْبَصِيرُ
“ পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মাসজিদুল হারাম হতে মাসজিদুল আকসায়, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বারাকাতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। ”
[সুরা আল-ইসরা, ১]
ইসরা ও মিরাজ হলো রাসূলুল্লাহ ﷺ কে দেয়া কুরআনের পর অন্যতম মহান নিদর্শন ও অলৌকিক ঘটনা। ইসরা মানে হলো মক্কা থেকে জেরুজালেমে রাতে ভ্রমন এবং মিরাজ মানে হলো আকাশের দিকে উত্থান।
ভাষাগত দিক থেকে তাই, আল-কুদস মানে হলো পবিত্র বা বিশুদ্ধ স্থান। এখানে “বিশুদ্ধ” দ্বারা বোঝানো হয় সেই বিষয়টি যে, অত্যাচারী বা অসৎ লোক কখনোই এই স্থান দখল করতে পারবে না। ইতিহাসে দেখা যায় যে, বিভিন্ন সময়ে ক্রুসেডারদের, মোঙ্গলদের, নেপোলিয়ন বোনাপার্টের প্রতিরক্ষা বাহিনীর এবং অন্য অনেকেরই ফিলিস্তিনে এসে পিঠ ঠেকেছে। ফিলিস্তিন থেকে অন্যায় ও অত্যাচার নির্মূলের এই প্রচেষ্টা চলতে থাকবে যতক্ষণ না চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাবে, যখন সত্য মাসিহ, নবী ঈসা عليه السلام ফিরে আসবেন, যার মাধ্যমে দাজ্জালের (Anti-Christ) সমাপ্তি ঘটবে ও ইসলামের সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“তিনটি মসজিদ ব্যতীত কোনো নির্দিষ্ট মসজিদে সফরের নিয়তে যেও না: মসজিদ আল-হারাম, মসজিদ আল-আকসা এবং এই আমার মসজিদ (মসজিদে নববী)।”
[বুখারি]
এই হাদীসটি যখন বলা হয়েছিল, তখন মসজিদ আল-আকসা মুসলমানদের অধীনে ছিল না। এটি ছিল একধরনের ভবিষ্যদ্বাণী এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ –এর ইতিবাচক মানসিকতা, যা দ্বারা তিনি সাহাবাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন।
উলামায়ে কেরামের ইজমা (ঐকমত্য) আছে যে মসজিদ আল-আকসা–তে সালাত আদায়ের বিশেষ সওয়াব আছে। আবু জর্ رضي الله عنه বর্ণনা করেন: “আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ –এর সঙ্গে বসে আলোচনা করছিলাম, কোনটি উত্তম: রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর মসজিদ, না বায়তুল মাকদিস (জেরুজালেম)। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন:
‘আমার মসজিদে একটি সালাত, সেখানে (বায়তুল মাকদিসে) আদায় করা চারটি সালাতের চেয়ে উত্তম। আর সেটি (বায়তুল মাকদিস) কতই না উত্তম নামাযের স্থান! শীঘ্রই এমন সময় আসবে, যখন একজন ব্যক্তি যদি ঘোড়ার দড়ির সমান জমির মালিক হয় যেখান থেকে বায়তুল মাকদিস দেখা যায়, তবে সেটিই তার জন্য পুরো পৃথিবীর চেয়ে উত্তম হবে।’
[মুস্তাদরাক আল-হাকিম]
এই হাদিসে মসজিদ আল-আকসায় সালাত আদায়ের সওয়াব বর্ণনার পাশাপাশি আরও একটি ভবিষ্যদ্বাণী দেখতে পাই। রাসূলুল্লাহ ﷺ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে কিয়ামতের কাছাকাছি সময়ে মুসলমানদের জন্য মসজিদ আল-আকসা–তে সালাত আদায় করা কঠিন হয়ে পড়বে।
ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদে সালাত আদায়ের সওয়াব কত?
আবদুল্লাহ ইবনে আয-জুবায়র رضي الله عنه থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“আমার এই মসজিদে (মদিনায়) একবার সালাত আদায় করা অন্য কোথাও এক হাজার সালাতের চেয়ে উত্তম, মসজিদ আল-হারাম ব্যতীত। আর মসজিদুল হারামে সালাত আদায় করা আমার মসজিদে আদায়কৃত সালাতের চেয়ে একশ গুণ উত্তম।”
[আহমাদ]
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ رضي الله عنه থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“আমার মসজিদে একটি সালাত অন্য কোথাও এক হাজার সালাতের সমতুল্য, তবে মসজিদ আল-হারাম ব্যতীত। আর মসজিদ আল-হারামে একটি সালাত অন্যত্র এক লক্ষ সালাতের চেয়ে উত্তম।”
[ইবন মাজাহ]
এই হাদীসগুলো থেকে আমরা জানতে পারি:
- মসজিদ আল-হারামে একটি সালাত = ১,০০,০০০ সালাত
- মসজিদ আন-নববিতে একটি সালাত = ১,০০০ সালাত
- মসজিদ আল-আকসায় একটি সালাত = ২৫০ সালাত
আরো একটি হাদিসে, আবূ আদ-দারদা رضي الله عنه বলেন: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“মসজিদ আল-হারামে সালাত আদায় করা এক লক্ষ সালাতের সমতুল্য, আমার মসজিদে আদায় করা এক হাজার সালাতের সমান এবং জেরুজালেমে (মসজিদ আল-আকসা) আদায় করা সালাত পাঁচশত সালাতের সমান।”
[তাবরানী]
কিছু হাদিস যেমন আগেরটিতে বর্ণিত হয়েছে, সেখানে ৫০০ গুণ সওয়াব বলা হয়েছে, তবে إن شاء الله যে রেওয়ায়াতগুলোতে ২৫০ গুণ সওয়াব উল্লেখ আছে, সেগুলো অধিক সহীহ।
মায়মুনা বিনতে সা’দ رضي الله عنها বর্ণনা করেন:
“আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমাদেরকে বায়তুল মুকাদ্দাস সম্পর্কে শরীয় বিধান বলুন।’ রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন:
‘এটি হল হাশর ও পুনরুত্থানের ভূমি। সেখানে যাও এবং নামায পড়ো, কেননা সেখানে একটি নামায অন্যত্র পড়া এক হাজার নামাযের সমান।’ তিনি বললেন, ‘যদি কেউ সেখানে যাওয়ার ক্ষমতা না রাখে?’ রাসূল ﷺ বললেন:
‘সে যেন সেখানকার বাতি জ্বালানোর জন্য কিছু তেল উপহার পাঠায়, কেননা যে এটা করবে, সে যেন নিজেই সেখানে গিয়েছে।’
[শরহ মুশকিল আল-আসার]
এই হাদিসকে শাইখ আল-আরনাউত رحمه الله সহীহ বলেছেন।
রাসূলুল্লাহ ﷺ আরও বলেন: “যে ব্যক্তি বায়তুল মাকদিস থেকে উমরাহ শুরু করবে, তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।”
[ইবন হিব্বান]
এই হাদিসে সনদের মধ্যে সামান্য দুর্বলতা রয়েছে, কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে রাসূল ﷺ–এর সাহাবীদের মধ্যে যেমন ইবন উমরرضي الله عنه –এর ন্যায় অনেকেই মসজিদ আল-আকসা থেকে ইহরাম বেঁধে উমরাহ করেছেন।
ইবনে আব্বাস رضي الله عنه বলেন:
“বায়তুল মাকদিস নবিগণ দ্বারা নির্মিত এবং তাদের বাসস্থান। সেখানে এমন এক হাত পরিমাণ স্থানও নেই, যেখানে কোনো নবি সালাত আদায় করেননি অথবা কোনো ফেরেশতা দাঁড়াননি।”
[আহমাদ ও তিরমিযি]
রাসূল ﷺ বলেন:
“এটি কত চমৎকার ইবাদতের স্থান! নিশ্চয়ই এমন সময় আসবে, যখন একজন ব্যক্তির কাছে তার ঘোড়ার রশির সমান জমিও যদি থাকে যেখান থেকে বায়তুল মাকদিস দেখা যায়, সেটি তার জন্য পুরো দুনিয়ার চেয়েও উত্তম হবে।”
অথবা তিনি বলেন:
“দুনিয়া ও তার ভেতরের সবকিছুর চেয়েও উত্তম।”
[মুস্তাদরাক আল-হাকিম]
তবে এত উচ্চ মর্যাদা সত্ত্বেও, মসজিদ আল-আকসা ‘হারাম’ নয় সেই অর্থে যেমন মক্কা ও মাদীনা ‘হারাম’ এলাকা হিসেবে স্বীকৃত।
আবু সাঈদ আল-খুদরী رضي الله عنه বলেন:
রাসূল ﷺ বলেন:
“হে আল্লাহ! ইবরাহীম মক্কাকে হারাম (পবিত্র এলাকা) বানিয়েছেন এবং আমি মদীনাকে হারাম বানিয়েছি… সেখানে কোনো রক্তপাত করা যাবে না, যুদ্ধের অস্ত্র বহন করা যাবে না, এবং কোনো গাছ ঝাঁকিয়ে পাতা ফেলা যাবে না, শুধুমাত্র পশুর খাদ্যের জন্য ব্যতিক্রম।”
[মুসলিম]
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ رحمه الله বলেন:
“বায়তুল মাকদিস এমন কোনো স্থান নয় যাকে ‘হারাম’ বলা যায়, না ইবরাহীম আলাইহিস সালাম–এর কবর বা অন্য কোনো স্থান। কেবলমাত্র মক্কা শরিফ, যেটিকে হারাম বলা হয় মুসলমানদের ইজমা অনুযায়ী এবং মাদীনা শরিফ, যেটিকে হারাম বলা হয় অধিকাংশ আলেমের মতে।”
[মাজমু’ আল-ফাতাওয়া]
আল্লাহ তাআলা বলেন:
سُبْحَـٰنَ ٱلَّذِىٓ أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِۦ لَيْلًۭا مِّنَ ٱلْمَسْجِدِ ٱلْحَرَامِ إِلَى ٱلْمَسْجِدِ ٱلْأَقْصَا ٱلَّذِى بَـٰرَكْنَا حَوْلَهُۥ لِنُرِيَهُۥ مِنْ ءَايَـٰتِنَآ ۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلْبَصِيرُ
“পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মাসজিদুল হারাম হতে মাসজিদুল আকসায়, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বারাকাতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।”
[সূরা আল-ইসরা, ১৭:১]
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে লক্ষ্যযোগ্য হলো যে, “মসজিদ” শব্দটি রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর আবির্ভাবের আগেও পরিচিত ছিল। যখন এই আয়াত নাজিল হয়:
سُبْحَـٰنَ ٱلَّذِىٓ أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِۦ لَيْلًۭا مّ مَّنَ ٱلْمَسْجِدِ ٱلْحَرَامِ إِلَى ٱلْمَسْجِدِ ٱلْأَقْصَا ٱلَّذِى بَـٰرَكْنَا حَوْلَهُۥ لِنُرِيَهُۥ مِنْ ءَايَـٰتِنَآ ۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلْبَصِ
[সূরা আল-ইসরা, ১]
মক্কার মুশরিকরা, যারা রাসূল ﷺ –কে নিয়ে উপহাস করার জন্য সবসময় অজুহাত খুঁজত, তারা কিন্তু এই নামটিকে অচেনা বলে প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তারা বলেনি, “আমরা তো ‘মসজিদ আল-আকসা’ নামে কিছু জানি না।” তারা এটার নাম ‘মসজিদ’ হওয়া অস্বীকার করেনি, বরং এটা ইঙ্গিত করে যে এই নাম তাদের কাছে আগে থেকেই পরিচিত ছিল।
আরবি ভাষার আলেমরা বলেন, “মসজিদ” শব্দটি জাহিলি যুগের আরবদের মাঝেও প্রচলিত ছিল। এর অর্থ ছিল—“যে স্থান সিজদার জন্য নির্ধারিত”, আর যেকোনো ইবাদতের স্থানই ছিল এক অর্থে মসজিদ।
ইসলাম, নবি মুহাম্মদ ﷺ–এর আবির্ভাবের আগেও, পূর্ববর্তী নবীদের শরিয়াতে সিজদা অন্তর্ভুক্ত ছিল—এবং সে কারণে ইবাদতের স্থানে সিজদা হতো, আর এ থেকেই “মসজিদ” শব্দের উৎপত্তি।
আশ-শামের ফযীলত
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَٱلتِّينِ وَٱلزَّيْتُونِ
“ডুমুর ও জলপাইয়ের কসম।”
[সূরা আত-তীন, ১]
আমরা মুসলমানরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর নামে শপথ করতে পারি না। তবে আল্লাহ যা ইচ্ছা, তাই দ্বারা শপথ করতে পারেন।
আল্লাহ যখন কোনো কিছুর নামে শপথ করেন, সেটির মহত্ত্ব ও গুরুত্ব প্রকাশ করার জন্যই করেন।
তাফসিরবিদগণের মধ্যে যেমন ইমাম কা’ব আল-আহবার, কাতাদা, ইবনু যায়েদ رحمهم الله—এবং অন্যান্য অনেকেই এই আয়াত সম্পর্কে বলেন: “এখানে ডুমুর ও জলপাই দ্বারা উদ্দেশ্য বায়তুল মাকদিস।” এই দুই ফল এমন অঞ্চলে জন্মে যেখানে নবীরা বসবাস করতেন—সেটি আশ-শাম, বিশেষ করে ফিলিস্তিন। এটি সেই ভূমি যেখানে বহু নবী عليهم السلام জন্মগ্রহণ করেছেন, দাওয়াত দিয়েছেন, এবং কবরস্থ আছেন। এই আয়াতের আরেক ব্যাখ্যা হলো, আল্লাহ এই ভূমির শপথ করেছেন, কারণ তা নবী মূসা عليه السلام, ঈসা عليه السلام এবং আমাদের নবী মুহাম্মদ ﷺ–এর সাথে সম্পর্কযুক্ত। এই দ্বিতীয় ব্যাখ্যাও প্রথম ব্যাখ্যার ফযীলতকেই সমর্থন করে।
জায়দ ইবন সাবিত رضي الله عنه বর্ণনা করেন:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: “আশ-শাম কতই না বরকতময় ভূমি!” সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, কেন?”
রাসূল ﷺ বললেন: “আমি দেখতে পাচ্ছি, আল্লাহর ফেরেশতারা আশ-শামের উপর তাদের ডানা বিস্তার করেছেন।”
[তিরমিযি]
ইমাম ইবন রজব আল-হাম্বলী رحمه الله বলেন: “আশ-শামে বরকত বলতে বোঝানো হয়েছে, দ্বীন ও দুনিয়া উভয় দিকেই এটি বরকতময়। এ কারণেই এই ভূমিকে ‘পবিত্র’ বলা হয়।”
বহু শতাব্দী ধরে বহু ইমাম যেমন— ইবন আসাকির, আবুল হাসান আর-রাবি’, শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ, ইবন রজব আল-হাম্বলী প্রমুখ আশ-শামের ফযীলতের উপর গ্রন্থ রচনা করেছেন।
আবু উমামা رضي الله عنه থেকে বর্ণিত: আমি জিজ্ঞেস করলাম, “হে আল্লাহর রাসূল ﷺ, আপনার বিষয়টি (নবুয়াত প্রাপ্তি) শুরু কীভাবে হয়েছিল?” তিনি বললেন: “আমার পিতা ইব্রাহীমের দোয়া এবং ঈসা আলাইহিস সালামের সুসংবাদের মাধ্যমে। আমার মা স্বপ্নে দেখলেন, তাঁর শরীর থেকে এক আলো বের হয়ে আশ-শামের প্রাসাদগুলো আলোকিত করল।”
ইমাম ইবন কাসীর رحمه الله বলেন:
“রাসূল ﷺ–এর আলো আশ-শামের সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত হওয়া এটাই প্রমাণ করে যে, তাঁর দ্বীন ও শিক্ষা এই ভূমিতে টিকে থাকবে। এজন্য শেষ যুগে আশ-শাম হবে ইসলামের দুর্গ, এবং ঈসা ইবনু মারইয়াম আলাইহিস সালাম সেখানেই অবতরণ করবেন।”
[তাফসীর ইবন কাসীর]
একবার ইবন মাসউদ رضي الله عنه–কে বলা হলো: “ফুরাত নদীর পানি কমে যাচ্ছে।” তিনি বললেন: “পানি ও মু’মিনরা সবসময় আশ-শামে থাকবে।”
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“হে আল্লাহ! আমাদের শামে বরকত দান করুন! হে আল্লাহ! আমাদের ইয়েমেনে বরকত দান করুন!” লোকেরা বলল, “আর আমাদের নাজদের জন্যও প্রার্থনা করুন (যা ইরাক অঞ্চলকে ঘিরে)।” তিনি আবার বললেন: “হে আল্লাহ! আমাদের আশ-শামের প্রতি বরকত দান করুন! হে আল্লাহ! আমাদের ইয়েমেনের প্রতি বরকত দান করুন!” লোকেরা আবার বলল, “হে আল্লাহর রাসূল ﷺ! আমাদের নাজদের জন্যও প্রার্থনা করুন।” বর্ণনাকারী বলেন, “আমার ধারণা, তৃতীয়বার রাসূল ﷺ বললেন: ‘সেটি (নাজদ) ভূমিকম্প ও ফিতনার স্থান, এবং সেখান থেকেই শয়তানের শিং উদিত হবে।’”
[বুখারি]
উম্মাহর সুস্থতাও এই শামের সাথে সম্পর্কিত। ইমাম তিরমিযি رحمه الله বর্ণনা করেছেন যে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“যখন আশ-শামের অধিবাসীরা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে, তখন তোমাদের জন্য তাতে কোনো কল্যাণ থাকবে না। আমার উম্মাহর একটি দল সর্বদা থাকবে, যাদেরকে আল্লাহ সাহায্য করবেন; যারা তাদের থেকে আলাদা হয়ে যাবে, তারা তাদের ক্ষতি করতে পারবে না—এই অবস্থা কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে।” আলী ইবনুল মাদিনী رحمه الله বলেন: “এরা হলেন হাদীসের লোকেরা।”
[তিরমিযি]
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“আল্লাহর নির্বাচিত ভূমি হলো আশ-শাম, আর এতে রয়েছেন তাঁর নির্বাচিত বান্দা ও দাসরা। আমার উম্মতের একটি দল অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে—হিসাব ছাড়াই, শাস্তি ছাড়াই।”
[তাবারানি]
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“আমি ইসরা ও মি’রাজের রাতে একটি মুক্তার মতো শুভ্র স্তম্ভ দেখলাম, যেটি ফেরেশতারা বহন করছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা কী বহন করছ?’ তারা বলল, ‘এটি কিতাবের স্তম্ভ। আমাদের আদেশ দেওয়া হয়েছে, এটি শামে স্থাপন করতে।’ পরে আমি স্বপ্নে দেখলাম, কিতাবের স্তম্ভটি আমার মাথার পাশে থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আমি ভাবলাম, আল্লাহ কি দুনিয়ার মানুষদের ত্যাগ করে দিচ্ছেন? আমার চোখ সেই স্তম্ভটিকে অনুসরণ করছিল—এটি ছিল এক উজ্জ্বল আলো। আমি দেখলাম, এটি আশ-শামে স্থাপন করা হয়েছে।”
[তাবারানি]
এ-রকম আরেকটি বর্ণনায় এসেছে: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“আমি স্বপ্নে দেখলাম, ফেরেশতারা কিতাবের স্তম্ভ বহন করে নিয়ে যাচ্ছে আশ-শামের দিকে। যখন মহা ফিতনা নেমে আসবে, তখন ঈমান থাকবে আশ-শামে।”
[ইবন আসাকির]
এই হাদীসগুলো ইঙ্গিত করে যে আশ-শাম হবে ইসলাম ও কুরআনের রক্ষণাবেক্ষণের কেন্দ্র।শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ رحمه الله বলেন: “কিতাবের স্তম্ভ ও ইসলাম দ্বারা বোঝানো হয়েছে—তা যা ভিত্তি ও সহায়ক হিসেবে কাজ করে। এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে তাদের প্রতি, যারা কুরআন শিখে এবং তা অনুযায়ী আমল করে। এটি সেই হাদীসের মতো যেখানে রাসূল ﷺ বলেন: ‘ঈমানদারদের হৃদয়ভূমি হলো আশ-শাম।’”
[মাজমু’ আল-ফাতাওয়া]
তামীম আদ-দারী رضي الله عنه নামে একজন সাহাবী ছিলেন , তিনি নবম হিজরীতে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং পরে বায়তুল মাকদিসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। একাধিক সূত্রে বর্ণিত আছে, নবী ﷺ তাঁকে হেবরনের (Bayt Habrun) এলাকা বরাদ্দ করেছিলেন। তাঁর ও তাঁর গোত্রের লোকজন নবী ﷺ–এর কাছে এসে অনুরোধ করেন, তিনি যেন হেবরন তাদের জন্য নির্ধারণ করে দেন। রাসূল ﷺ সম্মতি দেন এবং তাঁদের নামে একটি দলিল লিখিয়ে দেন, যাতে লেখা ছিল: “আল্লাহর নামে, যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু। এটি সেই দলিল, যা মুহাম্মাদ, আল্লাহর রাসূল, তামীম আদ-দারী ও তাঁর সঙ্গীদের দিয়েছেন। আমি তোমাদের দান করলাম—বায়ত আ’ইনুন, হেবরন, আল-মারতুম, বায়ত ইব্রাহীম এবং তার সমস্ত কিছু। আমি এটি তোমাদের এবং তোমাদের বংশধরদের জন্য চিরকালীনভাবে দান করলাম। কেউ যদি এই বিষয়ে বিরোধিতা করে, তবে সে আল্লাহর বিরুদ্ধেই বিরোধিতা করল। সাক্ষী: আবু বকর ইবন আবি কুহাফা, উমর, উসমান ও আলী ইবন আবি তালিব।”
[মু’জাম আল-বুলদান]
এই দলিল রচনার সময় ফিলিস্তিন মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না; বরং এটি বাইজানটাইনদের শাসনের অধীনে ছিল। এটি ছিল একটি ভবিষ্যদ্বাণী যে, শীঘ্রই ফিলিস্তিন মুসলিম শাসনের অধীনে আসবে। যখন উমর رضي الله عنه -এর খেলাফতের সময় বায়তুল মাকদিস বিজিত হয়, তখন তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর তামিম আল-দারিকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করেন এবং জমিটি তাঁর বংশধরদের জন্য ওয়াক্ফ করে দেন। এটি ছিল মুসলমানদের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনের প্রথম ওয়াক্ফ (আল-মসজিদুল আকসা বাদে)। তামিম আল-দারি পরবর্তীতে বায়তুল মাকদিসের গভর্নরও নিযুক্ত হন।
নবী মুহাম্মদ ﷺ এই ঘটনাগুলো সাহাবাদের বলেছিলেন তখন, যখন আল-শাম ও বায়তুল মাকদিস পারস্য বা রোমানদের অধীনে ছিল। সাহাবাদের জীবন মূলত মক্কা ও পরে মাদিনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছিল। তবুও, নবী ﷺ এই ভূমির বরকত ও মর্যাদা সম্পর্কে বারবার জোর দিচ্ছিলেন। এটি একটি ইঙ্গিত দেয় কেন সাহাবারা ইসলামের বার্তা ছড়ানোর জন্য প্রাথমিক পর্যায়েই শামের দিকে রওনা হয়েছিলেন।
শামের জনগণের অনুরোধে, উমর رضي الله عنه মু’আয ইবনু জাবাল, আবু আদ-দারদা ও উবাদাহ ইবনুস সামিত رضي الله عنهم-কে শামে পাঠান। উবাদাহ ইবনুস সামিত رضي الله عنه ও তাঁর স্ত্রী উম্মু হারাম বিনত মিলহান ফিলিস্তিনে বসবাস শুরু করেন এবং সেখানে কুরআন ও হাদীস শিক্ষাদান করেন। তিনি মৃত্যুর পূর্বে ফিলিস্তিনেই শেষ হাদীসটি বর্ণনা করেন।
সুনাবিহি থেকে বর্ণিত, উবাদাহ ইবনুস সামিত رضي الله عنه বলেন, “আমি তাঁর মৃত্যু শয্যায় গিয়েছিলাম এবং কাঁদতে লাগলাম। তখন তিনি বললেন, ‘এ কী, তুমি কাঁদছ কেন? আল্লাহর কসম, যদি আমি শহীদ হই, তবে তোমার জন্য সুপারিশ করব, আর যদি পারি, তবে তোমার উপকার করব।’ এরপর তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে যত ভালো হাদীস শুনেছি, যা তোমার জন্য উপকারী, আজ আমি মৃত্যুর নিকটে দাঁড়িয়ে তা তোমাকে বলছি। আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে বলতে শুনেছি:
مَنْ شَهِدَ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ النَّارَ
“যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ব ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল, আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবেন।”
[তিরমিযি]
উবাদাহ ইবনু সামিত رضي الله عنه-কে উমর رضي الله عنه বায়তুল মাকদিসের প্রথম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন, এবং আজও তাঁর বংশধররা ফিলিস্তিনে বসবাস করছেন।
শাম এমন এক অঞ্চল, যেখানে ইসলামের সূচনাতেই সাহাবারা দাওয়াত ও প্রসারের জন্য গমন করেন। ইমাম ইবনু আবি দাউদ رحمه الله বর্ণনা করেন, আল-ওয়ালিদ ইবনু মুসলিম رحمه الله বলেন:
“১০,০০০ চোখ, যারা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে দেখেছে, তারা শামের ভূমিতে প্রবেশ করেছিল।”
[তারিখ আদ-দিমাশক]
আমরা দেখি যে বহু সাহাবি আল-শামে দাফন হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ, নু’মান ইবনু বাশীর ও সাওবান رضي الله عنهم হোমস শহরে; শাদ্দাদ ইবন আওস ও উবাদাহ ইবনুস সামিত رضي الله عنهم আল-মসজিদুল আকসার পাশেই; মু’আবিয়াহ ইবনু আবি সুফিয়ান ও দিহইয়া ইবনু কালবি رضي الله عنهم দামেস্কে; বিলাল ইবনু রাবাহ رضي الله عنه আলেপ্পোতে; আর মু’আয ইবনু জাবাল ও জা‘ফার ইবনু আবি তালিব رضي الله عنهم বর্তমান জর্ডান এলাকায় দাফন হন। এছাড়াও বায়তুল মাকদিস সফর করেন—উমর ইবনুল খাত্তাব, আবু উবায়দাহ আমির ইবনুল জাররাহ, সাফিয়্যাহ বিনত হুয়াইয়্য, আবদুল্লাহ ইবনু উমর, আবু আদ-দারদা, সালমান আল-ফারসি, আমর ইবনুল আস, সাঈদ ইবনু যায়দ এবং আবদুল্লাহ ইবনু আমর رضي الله عنهم সহ আরও অনেকে।
ইমাম বুখারি رحمه الله তাঁর সহীহে একটি অধ্যায় রেখেছেন:
“যারা পবিত্র ভূমিতে দাফন হতে চেয়েছেন।”
এই অধ্যায়ের অধীনে তিনি নবী মূসা عليه السلام-এর বিখ্যাত হাদীসটি আনেন।
আবু হুরাইরা رضي الله عنه থেকে বর্ণিত, ফেরেশতা মালাকুল মাউত নবী মূসা عليه السلام-এর কাছে পাঠানো হয়। তিনি ফেরেশতাকে একটি থাপ্পড় মারেন, ফলে তাঁর চোখ নষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহ তা’আলা ফেরেশতার চোখ ফিরিয়ে দিয়ে বলেন:
“তার (মূসার) হাত একটি গরুর পিঠে রাখো, তিনি যত চুলের উপর হাত রাখবেন, তত বছর তিনি বাঁচবেন।”
এরপর মূসা عليه السلام জিজ্ঞেস করেন, “তারপর কী হবে?”
আল্লাহ বলেন, “তারপর মৃত্যু।”
তিনি বলেন, “তাহলে এখনই হোক।” তিনি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেন যেন তাঁকে পবিত্র ভূমির এক পাথর নিক্ষেপ দূরত্বে রাখা হয়।
রাসূল ﷺ বলেন:
“আমি যদি সেখানে থাকতাম, তবে মূসা عليه السلام -এর কবর তোমাদের দেখিয়ে দিতাম, লাল বালির ঢিবির পাশে রাস্তার ধারে।”
[বুখারি]
সত্য নবুয়তের প্রমাণের একটি হচ্ছে ভবিষ্যদ্বাণী। শাদ্দাদ ইবন আওস رضي الله عنه বলেন, আমি একবার রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সঙ্গে ছিলাম এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “কী হয়েছে শাদ্দাদ?” আমি বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল! দুনিয়া আমার উপর ভারী হয়ে গেছে।”
তিনি বলেন:
“না, দুনিয়া তোমার উপর ভারী হয়নি। নিশ্চয়ই শাম বিজিত হবে, বায়তুল মাকদিস বিজিত হবে, এবং তুমি ও তোমার সন্তানগণ সেখানে ইমাম হবে—ইনশাআল্লাহ।”[তাবারানী]
এরপর শাদ্দাদ ইবন আওস رضي الله عنه শামের ও পরে আল-কুদসের বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি ৫৮ হিজরিতে ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এবং আল-মসজিদুল আকসার নিকটেই দাফন হন।
ড. উসামা আল-আসকার, একজন খ্যাতনামা ফিলিস্তিনি ইতিহাসবিদ ও লেখক, গবেষণায় উল্লেখ করেন:
“প্রায় ৪,০০০ সাহাবি ফিলিস্তিনে প্রবেশ করেন, যার মধ্যে ৩৬ জন ছিলেন শীর্ষস্থানীয় সাহাবি বা মুসলিম সেনাবাহিনীর নেতা। প্রায় ৩৮ জন সাহাবি ফিলিস্তিনে শহীদ হন এবং ৬৯ জন সাহাবি এক সময় ফিলিস্তিনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।”
উপরন্তু, আল্লাহ তাআলা কুরআনে বহুবার এই পবিত্র ভূমির কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে একটি:
يَـٰقَوْمِ ٱدْخُلُوا۟ ٱلْأَرْضَ ٱلْمُقَدَّسَةَ ٱلَّتِى كَتَبَ ٱللَّهُ لَكُمْ
“(মূসা বললেন) হে আমার কওম! সেই পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ কর, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্ধারিত করেছেন।”
[সূরা আল-মায়িদাহ, ২১]
এখানে ভূমিকে বলা হয়েছে “الْأَرْضَ ٱلْمُقَدَّسَةَ” — অর্থাৎ পবিত্র ভূমি। “আল-মুকাদ্দাস” অর্থ- যা বরকতময়, যা পবিত্র করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা হলেন “আল-কুদ্দুস”—অর্থাৎ সবচেয়ে পবিত্র। এই নামের তাৎপর্য হচ্ছে—শুধুমাত্র আল্লাহই বরকত প্রদান করেন। কেউই নিজের শক্তিতে আল্লাহর দয়া বা বরকতের একচ্ছত্র দাবিদার হতে পারে না। তিনি যাকে ইচ্ছা দেন, আবার যার থেকে ইচ্ছা তা কেড়ে নেন।
এই ভূমিকে বিভিন্ন বর্ণনায় “বাইতুল মাকদিস” বা “আল-বাইতুল মুকাদ্দাস” বলা হয়েছে, যার অর্থ—পবিত্র গৃহ বা যে ঘরকে পবিত্র করা হয়েছে। এমনকি হিব্রু ভাষাতেও জেরুজালেমকে বলা হয় “ইয়েরুশালাইম (Yerushalayim)” বা “উরুশালিম (Urushalim)”, যার অর্থ—শান্তি বা পরিপূর্ণতা।
এটি বিশ্বের অন্যতম উর্বর ভূমি, যা বরকতময় অলিভ গাছের আবাসস্থল, অসংখ্য নবী ও রাসূল عليهم السلام-এর বাসস্থান, এবং ইসলামী ইতিহাসের অনেক জ্ঞানের বাতিঘরকে জন্ম দিয়েছে। কিয়ামতের বহু বড় নিদর্শন এখানেই সংঘটিত হবে।
وَنَجَّيْنَـٰهُ وَلُوطًا إِلَى ٱلْأَرْضِ ٱلَّتِى بَـٰرَكْنَا فِيهَا لِلْعَـٰلَمِينَ
“এবং আমরা তাকে ও লূতকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলাম সে দেশে, যেখানে আমরা কল্যাণ রেখেছি সৃষ্টিজগতের জন্য” [সূরা আল-আন্বিয়া, আয়াত ৭১]
وَأَوْرَثْنَا ٱلْقَوْمَ ٱلَّذِينَ كَانُوا۟ يُسْتَضْعَفُونَ مَشَـٰرِقَ ٱلْأَرْضِ وَمَغَـٰرِبَهَا ٱلَّتِى بَـٰرَكْنَا فِيهَا
“যে সম্প্রদায়কে দুর্বল মনে করা হত তাদেরকে আমরা আমাদের বরকত্ময় রাজ্যের পূর্ব ও পশ্চিমের উত্তরাধিকারী করি;” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত ১৩৭]
وَلَقَدْ بَوَّأْنَا بَنِىٓ إِسْرَٰٓءِيلَ مُبَوَّأَ صِدْقٍۢ وَرَزَقْنَـٰهُم مِّنَ ٱلطَّيِّبَـٰتِ
“আর নিশ্চয়ই আমি বনি ইসরাঈলকে একটি নিরাপদ ও উত্তম বাসস্থানে বসতি দিয়েছিলাম এবং তাদেরকে উত্তম রিযিক দিয়েছিলাম।” [সূরা ইউনুস, আয়াত ৯৩]
وَجَعَلْنَا بَيْنَهُمْ وَبَيْنَ ٱلْقُرَى ٱلَّتِى بَـٰرَكْنَا فِيهَا قُرًۭى ظَـٰهِرَةًۭ
“আর আমি তাদের ও যেসব জনপদসমূহের মাঝে বরকত দিয়েছিলাম, সেগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে অনেক দৃশ্যমান জনপদ স্থাপন করেছিলাম।” [সূরা সাবা, আয়াত ১৮]
وَلِسُلَيْمَـٰنَ ٱلرِّيحَ عَاصِفَةًۭ تَجْرِى بِأَمْرِهِۦٓ إِلَى ٱلْأَرْضِ ٱلَّتِى بَـٰرَكْنَا فِيهَا ۚ وَكُنَّا بِكُلِّ شَىْءٍ عَـٰلِمِينَ
“আর আমি সুলায়মানের অধীন করেছিলাম প্রচণ্ড বেগে বয়ে যাওয়া বাতাসকে, যা তার আদেশে চলত সেই ভূমির দিকে, যেটিকে আমি বরকতময় করেছিলাম। আর আমি সব কিছুর ব্যাপারে সবিশেষ অবগত ছিলাম।” [সূরা আল-আন্বিয়া, আয়াত ৮১]
এই কুরআনিক আয়াতগুলো থেকেই আমরা জানতে পারি যে শাম (আল-শাম) ভূমি একটি অনন্যরূপে বরকতময় ভূমি। এটি সেই অঞ্চল যেখানে নবী ইবরাহিম عليه السلام হিজরত করেছিলেন, যেখানে বনি ইসরা’ইলকে তাদের পরীক্ষার পর আনা হয়েছিল, যেখানে নবী সুলাইমান عليه السلام -এর অতুলনীয় রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে সাবার জাতি যাতায়াত করত, এবং যেখানে নবী মুহাম্মদ ﷺ-এর মিরাজের রাতের সফরের গন্তব্য ছিল। শামের মধ্যেই আছে তূর সিনা পাহাড়, যেখানে আল্লাহ নবী মূসা عليه السلام -এর সাথে কথা বলেছেন এবং তাওরাত অবতীর্ণ করেছেন। এই অঞ্চলের মধ্যেই অবস্থিত আল-মসজিদুল আকসা, একটি পবিত্র স্থান যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নবুয়তের কেন্দ্র ছিল।
শাম বরাবরই এই উম্মাহর সৎ ও সত্যবাদী মানুষের আবাসস্থল ছিল এবং থাকবেও। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা বিজয়ী থাকবে এবং যারা তাদের পরিত্যাগ করবে, তারা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, যতক্ষণ না কিয়ামত সংঘটিত হয়।”
[ইবনু মাজাহ]
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ رضي الله عنه বলেন:
“শামের লোকেরা যাকে পরাজিত করবে, সে নিঃসন্দেহে সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে নিকৃষ্ট।”
[ফাযায়িলুশ শাম]
অন্য এক হাদীসে রাসূল ﷺ বলেন:
“পশ্চিমের লোকেরা সর্বদা প্রাধান্য বিস্তার করবে, যারা তাদের পরিত্যাগ করবে তারা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, যতক্ষণ না কিয়ামত আসে।”
[মুসলিম]
ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল رحمه الله ব্যাখ্যা করেছেন যে, “পশ্চিমের লোকেরা” বলতে শামের জনগণকে বোঝানো হয়েছে, কারণরাসূলুল্লাহ ﷺ মদীনায় অবস্থান করে এই কথা বলেছেন।
ইমাম আহমাদ رحمه الله আরও বর্ণনা করেন যে খুরাইম ইবনু ফাতিক আস-সুদ্দী رضي الله عنه বলেন:
“শামের লোকেরা আল্লাহর পৃথিবীতে চাবুক, যার মাধ্যমে আল্লাহ যার থেকে ইচ্ছা, যেমনভাবে ইচ্ছা প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। তাদের মুনাফিকরা কখনো মু’মিনদের উপর বিজয়ী হবে না এবং তারা দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ বা দুঃখের মাঝে মৃত্যু বরণ করবে না।”
[আহমাদ]
মক্কা হচ্ছে “উম্মুল কুরা” বা নগরসমূহের মা, যেখান থেকে পৃথিবী বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু শাম এমন একটি ভূমি যা কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে মানবজাতির জমায়েতের স্থান হবে, আল্লাহর পরিকল্পনায় এটির রয়েছে এক বিশেষ স্থান। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“শাম হলো জমায়েত ও পুনরুত্থানের ভূমি।”
[আহমাদ]
এখানেই নবী ঈসা عليه السلام অবতীর্ণ হবেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“ঈসা ইবনু মারইয়াম দামেস্কের পূর্ব পাশে অবস্থিত সাদা মিনার বরাবর নেমে আসবেন। তার গায়ে হালকা রঙের দুটি কাপড় থাকবে, এবং তিনি দুই ফেরেশতার ডানায় হাত রাখবেন। যখন তিনি মাথা নিচু করবেন, তখন তার থেকে পানির ফোঁটা ঝরবে, আর যখন তিনি মাথা তুলবেন, তখন মুক্তার মতো ঝরে পড়বে।”
[মুসলিম]
তেমনি, ইসলামের বিস্তার শুরু হয়েছিল যখন নবী মুহাম্মদ ﷺ-কে মক্কা থেকে বাইতুল মাকদিসে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর নবুয়ত ও বার্তা শুরু হয়েছিল মক্কায়, আর সেই বার্তার পরিপূর্ণতা, বিজয় ও পূর্ণতা হবে মাহদীর আগমনের মাধ্যমে শামে।
হে মুসলিমগণ! শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ رحمه الله -এর কথাকে হৃদয়ে ধারণ করো, তিনি বলেন:
“তোমরা যদি শামের লোকদের সাহায্য ও রক্ষা না করো, তাহলে আল্লাহ তাদের সাহায্য করার জন্য অন্যদেরকে প্রস্তুত করবেন! তিনি তোমাদের পরিবর্তে অন্যদের দিয়ে দেবেন! আল্লাহ বলেন:
وَإِن تَتَوَلَّوْا۟ يَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ ثُمَّ لَا يَكُونُوٓا۟ أَمْثَـٰلَكُم
‘আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে আল্লাহ তোমাদের পরিবর্তে অন্য এক জাতিকে নিয়ে আসবেন, যারা তোমাদের মতো হবে না।’
[সূরা মুহাম্মদ, ৩৮]
রাসূলুল্লাহ ﷺ একে বলেছেন “আমাদের শাম” — তাই আমরাও একে বলব “আমাদের শাম”।
শাম হলো নবীদের ভূমি। এ ভূমির মাটি ও মানুষ, উভয়ই বরকতময় — রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর দু’আর মাধ্যমে:
اللهم باركْ لنا في شامنا
“হে আল্লাহ! আমাদের শামের মধ্যে বরকত দান করুন।”
[তিরমিজি]
No Comment! Be the first one.