কুরবানির উৎস
‘আদহা’ শব্দটি ‘উধিয়াহ’ (কুরবানির পশু) এর বহুবচনের একটি রূপ, যা ঈদের দিনে ضُحَى -র (সকাল) সময়ে জবাই করা ভেড়াকে বোঝায়। তবে, ঈদের চার দিনের মধ্যে যেকোনো সময় জবাই করা ভেড়াকেও উধিয়াহ বলা হয়। উধিয়াহ বলতে এমন একটি পশু (উট, গরু, ভেড়া বা ছাগল) বোঝায়, যা শরিয়তসম্মতভাবে ঈদুল-আজহা অথবা ইয়াওমুত তাশরীক-এর দিনগুলোতে, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে জবাই করা হয় । ঈদুল-আজহা-কে আরেক নামে ডাকা হয় ইয়াওমুন নাহর। ‘আন-নাহর’ শব্দটি উট জবাই করার পদ্ধতির নাম।
আয়িশা رضِيَ ٱللَّٰهُ عَنْهَا বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “কুরবানির দিনে মানুষের এমন কোনো আমল নেই যা আল্লাহর নিকট পশু জবাই করার চেয়ে অধিক প্রিয়। কুরবানির পশুটি কিয়ামতের দিনে তার শিং, পশম ও খুর সহকারে আসবে। এর রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়। অতএব, বিশুদ্ধ নিয়তে কুরবানি করো।”
[তিরমিযি]
ইয়ামুত-তাশরীক কী?
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَاذْكُرُوا اللَّهَ فِي أَيَّامٍ مَعْدُودَاتٍ
"আর নির্ধারিত দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ করো।" [সূরা আল-বাকারা, ২০৩]
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “তাশরীকের দিনগুলো (ঈদুল-আজহা ও পরবর্তী ১১, ১২, ও ১৩ জিলহজ) হলো ভোজন, পান ও আল্লাহর জিকির করার দিন।” [মুসলিম]
ইমাম ইবন রজব আল-হাম্বলী رحمه الله বলেন: “তাশরীকের দিনগুলো মুমিনদের দেহ ও অন্তরের জন্য বরকত নিয়ে আসে:
- দেহের জন্য খাবার ও পানীয় দ্বারা;
- আর অন্তরের জন্য আল্লাহর জিকির ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে।”
কুরবানির প্রসঙ্গে, আল্লাহ কুরআনে বলেন:
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِين
"বলুন, আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু সবই আল্লাহর জন্য, যিনি সকল জগতের প্রতিপালক।"
[সূরা আন'আম, ১৬২]
উধিয়াহ / কুরবানির ইতিহাস
‘কুরবানি’ বা ‘উধিয়াহ‘ আরবি শব্দ, যার অর্থ হলো ত্যাগ। এটি নবী ইব্রাহিম عليه السلام কর্তৃক আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষিত হওয়ার সময় কুরবানি দেয়ার ঘটনা থেকে এসেছে।
এই কাহিনির দুটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় রয়েছে যা আমদের জানা উচিত:
প্রথমত, আল্লাহ কুরআনে আদম عليه السلام -এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিল-এর কাহিনী বর্ণনা করেছেন। তাদের মধ্যে বিরোধ মীমাংসার জন্য নবী আদম عليهم السلام তাদের দুজনকেই কুরবানি করতে বলেন; যার কুরবানি গ্রহণ করা হবে, সে-ই বিজয়ী হবে।
হাবিল, যিনি মেষপালক ছিলেন, একটি সুস্থ ও মোটা ভেড়া কুরবানি দেন। অপরদিকে কাবিল, যিনি কৃষিকাজ করতেন, জমিতে উৎপাদিত কিছু ফসল কুরবানি দেন। পার্থক্য হলো, হাবিল সেরা পশু কুরবানি দেন, আর কাবিল নিজের উৎপাদিত ফসলের ভালো অংশ দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। আল্লাহ হাবিলের কুরবানি গ্রহণ করেন এবং কাবিলেরটি প্রত্যাখ্যান করেন। হাবিল তার ভাইকে বলেন, “আল্লাহ শুধুমাত্র মুত্তাকীদের কাছ থেকেই কবুল করেন।” কিন্তু কাবিল ঈর্ষান্বিত হয়ে হাবিলকে হত্যা করে।
দ্বিতীয়ত, কুরবানির সবচেয়ে বিখ্যাত কাহিনি নবী ইব্রাহিম عليه السلام ও তাঁর পুত্র ইসমাঈল عليه السلام -কে নিয়ে। যখন ইসমাঈল عليه السلام বড় হয়ে বাবার সঙ্গে হাঁটাহাঁটি ও কাজ করতে সক্ষম হলেন, তখন নবী ইব্রাহিম عليه السلام স্বপ্নে দেখলেন যে তিনি তার পুত্রকে কুরবানি করছেন।
প্রথমে তিনি ভাবলেন এটা শয়তানের প্ররোচনা। কিন্তু স্বপ্নটি বারবার আসতে থাকলে তিনি বুঝলেন, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ।
এটি ছিল তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশাল পরীক্ষা। কারণ ইব্রাহীম عليه السلام দীর্ঘকাল নিঃসন্তান ছিলেন। আর এখন তিনি তার একমাত্র সন্তানকে নিজ হাতে কুরবানি করার নির্দেশ পেয়েছেন।
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ ٱلسَّعْىَ قَالَ يَـٰبُنَىَّ إِنِّىٓ أَرَىٰ فِى ٱلْمَنَامِ أَنِّىٓ أَذْبَحُكَ فَٱنظُرْ مَاذَا تَرَىٰ ۚ قَالَ يَـٰٓأَبَتِ ٱفْعَلْ مَا تُؤْمَرُ ۖ سَتَجِدُنِىٓ إِن شَآءَ ٱللَّهُ مِنَ ٱلصَّـٰبِرِينَ
"হে পুত্র, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে কুরবানি করছি; তুমি বলো, তোমার কী মত?"
ইসমাঈল عليه السلام উত্তর দেন: "হে আমার প্রিয় পিতা, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তা করুন; ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।"
[সূরা আস-সাফফাত, ১০২]
পুত্রের প্রতি ভালোবাসা সত্ত্বেও নবী ইব্রাহিম عليه السلام আল্লাহর আদেশ পালন করলেন, এবং ইসমাঈল عليه السلام ও পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করলেন এবং এই আদেশেকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেন না ঠিক যেমন তার মা হাজরা প্রশ্ন করেননি যখন ইব্রাহিম عليه السلام আল্লাহর আদেশে মরুভূমিতে তাকে সন্তানসহ রেখে এসেছিলেন বহু বছর আগে। তাই প্রশ্ন না করে তিনি তার বাবাকে নির্দ্বিধায় কুরবানি করতে বললেন।
বর্ণিত আছে যে, শয়তান ইব্রাহিম عليه السلام -এর অন্তরে সন্দেহ সৃষ্টি করার চেষ্টা করলে তিনি তিনবার তাকে পাথর নিক্ষেপ করেন। অন্য বর্ণনায় শয়তান ইব্রাহিম হাজরা ও ইসমাইল প্রত্যেকের কাছে আলাদাভাবে যায় এবং প্রতিবার অন্তরে সন্দেহ ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে এবং প্রতিবারই তিনি শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করেন।
[তাবারী]
তাই আজ পর্যন্ত হজে সেই রজম (শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ) পালন করা হয়।
ইব্রাহিম عليه السلام যখন কুরবানি করার জন্য ছুরি এবং দাফন করার জন্য কাফন প্রস্তুত করেন, তখন তিনি ইসমাঈল عليه السلام-এর দিকে তাকাতে পারেননি তাই তিনি তার মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে দেন। ইমাম ইবন কাসির رحمه الله -এর তাফসির অনুযায়ী, দুজনেই আল্লাহকে স্মরণ করলেন ও ঈমানের সাক্ষ্য দিলেন। এরপর ইব্রাহিম عليه السلام ছুরি চালাতে উদ্যত হলে, যখন ছুরি ইসমাইল عليه السلام এর গলার কাছে আনা হয়, তখন একটি আওয়াজ আসে যা তাকে থামতে বলে। আল্লাহ ইসমাঈল عليه السلام-এর পরিবর্তে একটি মেষ পাঠান ইব্রাহিম عليه السلام এর একনিষ্ঠতা ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের স্বীকৃতিস্বরূপ। ইব্রাহিম عليه السلام ইসমাইল এর পরিবর্তে একটি সাদা শিংওয়ালা মেষ কুরবানি করেছিলেন এবং পাথর নিক্ষেপের মত আমরা এই ঘটনার স্মরণে প্রতিবছর হজে পশু কুরবানি করে থাকি। এটি ইব্রাহিম عليه السلام -এর আনুগত্য ও ঈমানের স্বীকৃতি যিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তার প্রিয় সন্তানকেও কুরবানি করতে প্রস্তুত ছিলেন এবং এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য পুরস্কার ও বরকতস্বরূপ।
এই কারণে আমাদের প্রিয় রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “আমি দুই কুরবানি করা ব্যক্তির সন্তান।”
[হাকিম]
— অর্থাৎ, তাঁর পিতা আবদুল্লাহ এবং পূর্বপুরুষ ইসমাঈল عليه السلام উভয়ই কুরবানির জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। যা ইসমাইল عليه السلام এর সাথে তার সম্পর্ককে তুলে ধরে।
নবী ইব্রাহিম عليه السلام “খলীলুল্লাহ” (আল্লাহর ঘনিষ্ঠ বন্ধু) উপাধি লাভ করেন। এবং এই পরিবার থেকেই আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ ﷺ আগমন করেন। কী চমৎকার পরিবার সুবহানআল্লাহ!

আল্লাহ সেই ভেড়াটিকে কুরআনে “মহান কুরবানি” (a great sacrifice) বলে উল্লেখ করেছেন, আল্লাহ এর মহত্ব বুঝাতে আজিম শব্দ ব্যবহার করেছেন। ইবন আব্বাস رضي الله عنهما বলেন, সেটি ছিল এমন ভেড়া, যা ৪০ বছর জান্নাতে চরে বেড়িয়েছিল।
[তাবারী]
তাফসির আল-জালালাইন অনুযায়ী, এটি সেই ভেড়া যা হাবিল কুরবানি করেছিলেন এবং আল্লাহ তা কবুল করে জান্নাতে নিয়ে যান। পরে তা ইব্রাহিম عليه السلام -এর জন্য ফেরত পাঠানো হয়।
ইমাম আহমাদ رحمه الله বর্ণনা করেন, সাফিয়াহ বিনতে শাইবাহ বলেন: “বানু সুলাইমের এক মহিলা, যিনি আমাদের পরিবারের অনেকের ধাত্রী ছিলেন, আমাকে বলেছিলেন যে, একবার রাসূলুল্লাহ ﷺ উসমান বিন তালহা رضي الله عنه -কে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।” আমি উসমানকে জিজ্ঞেস করলাম, “রাসূলুল্লাহ ﷺ কেন আপনাকে ডাকলেন?” তিনি বললেন, “রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, ‘আমি কাবায় প্রবেশ করে মেষের শিং দুটি দেখেছি। আমি তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম — এগুলো ঢেকে দাও। কারণ কাবায় এমন কিছু থাকা উচিত নয় যা ইবাদতকারীকে অন্যমনস্ক করে।‘” সুফিয়ান বলেন: “সেই শিং কাবায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল, যতদিন না কাবা আগুনে পুড়ে যায়; তখন শিং দুটিও পুড়ে যায়।”
এটি প্রমাণ করে, কুরাইশরা সেই ভেড়ার শিং উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিল যা ইব্রাহিম عليه السلام কুরবানি করেছিলেন। এবং তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসে, যতদিন না রাসূলুল্লাহ ﷺ আগমন করেন।
আজও মুসলিম উম্মাহ বিশ্বব্যাপী কুরবানির মাধ্যমে এই স্মৃতি, আনুগত্য ও ত্যাগের ঘটনা স্মরণ করে থাকে — কারণ এটি আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের প্রতীক।
কুরবানি / উধিয়াহ কি বাধ্যতামূলক?
উধিয়াহ একটি সুন্নাহ, এবং যার সামর্থ্য রয়েছে অথচ কুরবানি দেয় না, তার এই কাজকে অপছন্দনীয় ( مكروه ) গণ্য করা হয়েছে। এটি একটি অত্যন্ত জোরালোভাবে উৎসাহিতকৃত সুন্নাহ। যদি কারো প্রকৃত আর্থিক সংকট থাকে, তবে তার জন্য শিথিলতা আছে এবং তার ওপর কঠোরতা আরোপ করা হবে না।
ইবনে উমর رضي الله عنه বর্ণনা করেন:
“আল্লাহর রসূল ﷺ মদীনায় দশ বছর অবস্থান করেছেন এবং প্রতি বছর কুরবানি করেছেন।” [তিরমিযি]
হানাফি মাযহাব অনুযায়ী, যে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন মুসলিম যার নেসাব পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, তার ওপর কুরবানি করা ওয়াজিব। অর্থাৎ, যদি কেউ যাকাত আদায়ের যোগ্য হন, তবে তার জন্য কুরবানিও করা আবশ্যক। এই অভিমতটি ইমাম আহমাদ رحمه الله , ইমাম মালিক رحمه الله, ইমাম আল-লায়স, আল-আওযাঈ, আস-সাওরি ও আওযায়িসহ অন্যান্য কিছু ইমামের পক্ষ থেকেও বর্ণিত হয়েছে।
আবু হুরায়রা رضي الله عنه বর্ণনা করেন: রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
“যে ব্যক্তি কুরবানি করার সামর্থ্য রাখে অথচ তা করে না, সে যেন আমাদের ঈদের নামাজের স্থানে না আসে।”
[ইবনে মাজাহ]
তবে বহু আলিম যেমন ইমাম তিরমিযি, আত-তাহাওয়ি, ইবনে হাজার প্রমুখ বলেন, এটি রাসূল ﷺ এর উক্তি নয় বরং আবু হুরায়রা رضي الله عنه -এর মতামত।
বেশিরভাগ আলেমের অভিমত হলো, এটি আবশ্যক নয় বরং জোরালো সুন্নাহ। শর্ত হলো, কুরবানির জন্য ব্যয় করতে হলে তা ব্যক্তির প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের পর অতিরিক্ত হতে হবে, এবং যারা তার উপর নির্ভরশীল তাদের প্রয়োজন পূরণ করাও জরুরি।
ইমাম ইবনে কুদামা رحمه الله বলেন:
“অধিকাংশ আলেমের মত হলো, উধিয়াহ একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ, আবশ্যক (ফরজ) নয়। এই মতটি আবু বকর, উমর, বিলাল, আবু মাসউদ আল-বাদরি থেকে বর্ণিত হয়েছে। একইভাবে এটি সুয়াইদ ইবন গুফালাহ, সাঈদ ইবন আল-মুসাইয়্যাব, আলকমা, আসওয়াদ, আতা, আশ-শাফিয়ী, ইসহাক, আবু সাওর, ও ইবনুল মুনজির-এর মত।”
দারাকুতনী-র সূত্রে বর্ণিত হাদীসে ইবন আব্বাস رضي الله عنهما বলেন, রাসূল ﷺ বলেছেন:
“তিনটি বিষয় আমার জন্য ফরজ, কিন্তু তোমাদের জন্য তা ঐচ্ছিক: বিতর, কুরবানি এবং ফজরের দুই রাকাত সুন্নত।”
রাসূল ﷺ আরও বলেছেন:
“যদি কেউ কুরবানি করতে চায়, সে যেন জিলহজ্বের প্রথম দশ দিন শুরু হওয়ার পর তার চুল ও ত্বক থেকে কিছুই না কাটে।” [মুসলিম]
এই হাদীসটি ইঙ্গিত দেয় যে কুরবানি করা ঐচ্ছিক কাজ, কারণ “যদি কেউ কুরবানি করতে চায়” বলা হয়েছে; বাধ্যতামূলক কোনো কাজ ইচ্ছার সঙ্গে সংযুক্ত হয় না। [আল-মুগনি (১১/৯৫)]
এই ব্যাখ্যার ভিত্তিতে ইমাম শাফিয়ী رحمه الله বলেন:
“এটি প্রমাণ করে যে উধিয়াহ আবশ্যক নয়, কারণ রাসূল ﷺ বলেছেন: ‘যদি কেউ কুরবানি করতে চায়’, যদি এটি ফরজ হতো তবে বলতেন: কেউ যেন কিছু না কাটে যতক্ষণ না সে কুরবানি করে।” [আল-মাজমু‘]
ইমাম আল-বায়হাকি رحمه الله আবু সারীহাহ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
“আমি আবু বকর ও উমরের সময়ে জীবিত ছিলাম; তারা আমার প্রতিবেশী ছিলেন এবং তারা কুরবানি করতেন না।” [মাআরিফাতুস সুনান ওয়াল আসার]
মূলনীতি হলো: কোনো আমল ফরজ নয় যতক্ষণ না তার ফরজ হওয়ার স্পষ্ট দলীল থাকে। অতএব, কুরবানি ফরজ নয় বলেই গ্রহণযোগ্য মত রয়েছে।
পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানি
উধিয়াহ প্রত্যেক পরিবারের সদস্যের জন্য বিধিবদ্ধ, শিশুরাও এর অন্তর্ভুক্ত। রাসূল ﷺ বলেছেন: “প্রত্যেক গৃহস্থালির লোকদের উচিত প্রতি বছর কুরবানি দেয়া।” [আহমাদ] এজন্য বাবা-মায়ের দায়িত্ব হলো তাদের সন্তানদের পক্ষ থেকে কুরবানি দেয়া।
আয়িশা رضي الله عنها বর্ণনা করেন, রাসূল ﷺ বলেছেন:
“মানবজাতির পক্ষ থেকে নাহরের দিনে এমন কোনো কাজ নেই যা আল্লাহর কাছে কুরবানির পশুর রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে বেশি প্রিয়। কিয়ামতের দিনে সে পশুটি তার শিং, পশম ও খুর নিয়ে উপস্থিত হবে, এবং তার রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহ তা কবুল করে নেন। অতএব, তোমার অন্তর এ নিয়ে খুশি হোক।” [তিরমিযি]
মূলনীতি হলো, জীবিত ব্যক্তি নিজের ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানি দেবে। সে চাইলে জীবিত বা মৃত অন্যদের জন্যও সওয়াবের নিয়তে শরিক করতে পারে। সুন্নাহ হচ্ছে ব্যক্তি তার পরিবারের লোকদের অন্তর্ভুক্ত করবে, জীবিত এবং মৃত। পরিবারের অংশ কারা? এটা হতে পারে তার সরাসরি পরিবার অথবা যাকে সে আর্থিকভাবে সহায়তা করে থাকে।
একটি পশু পুরো পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানি করা যথেষ্ট। আলাদা আলাদা প্রতিটি সদস্য বা মৃতব্যক্তির জন্য পৃথক পশু জবাই করা আবশ্যক নয়। মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানি করা বৈধ, কিন্তু এটিকে সুন্নাহ বলা যায় না।
কিছু হাম্বলি আলেম বলেন:
“মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানি দেয়া জীবিতদের তুলনায় উত্তম, কারণ মৃত নিজে কিছু করতে পারে না এবং তার জন্য সওয়াবের প্রয়োজন বেশি।” [মাতালিব উলি আন-নুহা]
ইমাম নববী رحمه الله বলেন:
” আবুল হাসান আল এব্বাদি মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানি দেয়াকে জায়েজ মনে করতেন কারণ এটি এক প্রকার দান, এবং মৃত ব্যক্তির জন্য দান করা বৈধ ও উপকারি।” [আল-মাজমু‘]
আবু আইয়ুব আল-আনসারী رضي الله عنه বলেন:
“রাসূল ﷺ এর যুগে একজন ব্যক্তি নিজের ও পরিবারের পক্ষ থেকে একটি ভেড়া কুরবানি করতেন, এবং তা থেকে খেতেন ও অন্যকে খাওয়াতেন।” [তিরমিযি]
ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ رحمه الله বলেন:
“যে বলে যে মৃত অন্যের আমল দ্বারা উপকার পায় না, সে ইজমা ভঙ্গ করেছে।” তাকে মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হয়। তিনি বলেন, হজ যেমন মৃতের পক্ষ থেকে করা যায়, কুরবানিও ঠিক তেমন।
ইমাম ইবন আবিদিন رحمه الله বলেন:
“যে ব্যক্তি মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানি করে, সে যেন নিজের জন্য কুরবানির মতোই তা জবাই করে এবং মাংস খায় ও বিতরণ করে; মালিকানা থাকে কুরবানিকারীর, আর সওয়াব মৃতের জন্য।” [হাশিয়াহ ইবন আবিদিন]
আলি ইবন আবু তালিব رضي الله عنه বর্ণনা করেন:
“হানাশ বলেন, আমি আলিকে দুটি ভেড়া কুরবানি করতে দেখেছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কেন? তিনি বললেন: রাসূল ﷺ আমাকে তার পক্ষ থেকে কুরবানি করতে বলেছিলেন, তাই আমি সেটাই করছি।” [আবু দাউদ]
অধিকাংশ আলেমগণের মতে এই হাদীসটি দুর্বল হলেও অনেক আলেম যেমন আবু দাউদ, যাহাবী, হাকিম, এবং সাম্প্রতিক আলেম শায়খ আহমাদ শাকির এটিকে গ্রহণযোগ্য বলেছেন।
ইমাম আহমাদ رحمه الله বর্ণনা করেন,
“রাসূল ﷺ তাঁর উম্মতের সেই গরীবদের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত কুরবানি করতেন যারা নিজেরা কুরবানি করতে পারত না, যারা আল্লাহর একত্ববাদ ও রিসালাতের স্বীকৃতি দেয়” [আহমাদ] সাহাবায়ে কিরাম এ সুন্নাহ অব্যাহত রেখেছিলেন।
আনাস ইবন মালিক رضي الله عنه বলেন: “রাসূল ﷺ দুইটি ভেড়া কুরবানি করতেন, তাই আমিও দুইটি কুরবানি করি।” [বুখারী]
এই সুন্নাহ আমাদের সময়ে পুনরুজ্জীবিত করা দরকার।
কিভাবে একজন ব্যক্তি কুরবানির ভাগ করবে?
- ১টি ভেড়া বা ছাগল = ১ ব্যক্তি ও তার পরিবার
- ১টি গরু বা উট = ৭ জন ও তাদের পরিবার (১ কুরবানি = গরু বা উটের ১/৭ অংশ)
একটি সম্পূর্ণ ভেড়া কুরবানি করা গরু বা উটের অংশের চেয়ে উত্তম।
জাবির ইবন আবদুল্লাহ رضي الله عنه বলেন:
“হুদায়বিয়ার বছরে (৬ হিজরী), আমরা রাসূল ﷺ এর সঙ্গে ছিলাম। আমরা ৭ জন মিলে একটি উট ও একটি গরু কুরবানি করেছিলাম।” [মুসলিম]
কুরবানির নিয়তকারী ব্যক্তি
যে ব্যক্তি কুরবানির নিয়ত করে, সে নিয়তটি অন্তরে করে, মুখে উচ্চারণ করা হয় না। ইমাম ইবন কুদামাহ رحمه الله বলেন: “নিয়তের অর্থ হলো কোনো কিছু করার দৃঢ় সংকল্প করা, অর্থাৎ হৃদয়ে এমন দৃঢ় সংকল্প রাখা যে, সে তা করবেই।”
এটি ব্যাখ্যা করেছেন ইমাম সুয়ুতী رحمه الله যিনি বলেন: “সালাতের জন্য নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা বিদআত, এটি রাসূল ﷺ এর সুন্নাহ নয় এবং সাহাবাদের পদ্ধতিও নয়। তাঁরা শুধু তাকবির দিতেন (সালাত শুরু করার সময়)।”
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ رحمه الله বলেন: “নিয়তের স্থান হলো হৃদয়, এটি নিয়ে আলেমদের ঐক্যমত রয়েছে।” কেননা রাসূল ﷺ কিংবা সাহাবারা কখনো বলেননি, ‘আমি রোযা রাখার নিয়ত করছি‘, ‘আমি সালাত আদায়ের নিয়ত করছি‘ ইত্যাদি। তাই নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা বিদআত এবং নতুন উদ্ভাবিত কাজ।
কিছু আলেম বলেন যে মুখে আস্তে করে নিয়ত উচ্চারণ করা মুস্তাহাব (recommended)। যদিও তাঁরা একমত যে নিয়তের স্থান হৃদয়, কিন্তু তাঁরা মনে করেন মুখে বললে মনোযোগ বাড়ে। তবে কোনো আমলকে মুস্তাহাব বলা একটি শরঈ হুকুম। কুরআন বা সুন্নাহ থেকে প্রমাণ ছাড়া কোনো কিছু মুস্তাহাব বলা ঠিক নয়। যেহেতু আস্তে নিয়তের ব্যাপারে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না তাই একে মুস্তাহাবের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। বরং মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা রিয়া বা দেখানোর মতো কাজ হয়ে যেতে পারে।
যে ব্যক্তি কুরবানির নিয়ত করে, তার জন্য জিলহজের প্রথম দশদিনে নিজের চুল, ত্বক বা নখ কাটা নিষিদ্ধ—যতক্ষণ না সে কুরবানি সম্পন্ন করে।
- হাম্বলি আলেমগণ এবং ইমাম ইসহাক ইবন রাহুয়াইহ رحمه الله এর মতে, এটি করা হারাম।
- আল-কাযি আবু ইয়ালা رحمه الله ও ইমাম মাজদ ইবনে তাইমিয়্যাহ رحمه الله বলেন এটি মাকরুহ, হারাম নয়। এটাই হাম্বলি মাযহাবের প্রধান দুটি মত এবং শাফঈ’ মাযহাবসহ অধিকাংশ আলেমদের মতও। তাঁরা বলেন চুল-নখ না কাটা মুস্তাহাব এবং এই পন্থা সাহাবি সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যিব رضي الله عنه থেকেও বর্ণিত।
- কিছু আলেম একে মুবাহ বলেও মনে করেন, যেমন হানাফি ও মালিকি মাযহাবের কিছু আলেম। তারা বলেন, এটি সুন্নাহও নয় এবং মাকরুহও নয় যে কেউ চুল কাটবে বা নখ ছাঁটবে, কারণ সে তো হাজীদের মতো ইহরামের অবস্থায় নেই। যে ব্যক্তির জন্য সুগন্ধি ব্যবহার করা এবং কাপড় পরা নিষিদ্ধ নয়, তার জন্য চুল কামানোও নিষিদ্ধ নয় — যেমনটি ইহরামের অবস্থায় থাকা ব্যক্তির জন্য নিষিদ্ধ।
মিশ্র সমাজে বসবাস করলে আল-কাযি আবু ইয়ালা رحمه الله এর মত অনুযায়ী ফতওয়া দেওয়া নিরাপদ। যদি কেউ জিলহজ শুরু হওয়ার পরে কুরবানির নিয়ত করে এবং এর আগে সে নখ, চুল ইত্যাদি কেটে ফেলে — তবে এখন থেকে সে তা থেকে বিরত থাকবে। এই বিধান কার্যকর হয় নিয়ত করার সময় থেকে।
চুল ও নখ কাটা নিষিদ্ধ হওয়ার পেছনের হিকমাহ হলো—যিনি কুরবানি দিতে যাচ্ছেন, তিনি কিছু আমলের দিক থেকে হজ ও উমরার ইহরামে থাকা ব্যক্তির মতো হয়ে যান, যার মধ্যে অন্যতম হলো—আল্লাহর কাছে নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে কুরবানি প্রদান। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: “যখন তোমরা জিলহজের চাঁদ দেখো, এবং তোমাদের কেউ কুরবানি দিতে চায়, তাহলে সে যেন তার চুল ও নখ না কাটে।” [মুসলিম]
এই নিষেধাজ্ঞা সেই ব্যক্তির উপর প্রযোজ্য যিনি কুরবানি দিচ্ছেন। এটি তার স্ত্রী, সন্তান বা পরিবারের অন্য সদস্যদের উপর প্রযোজ্য নয়—যতক্ষণ না তাদের কেউ নিজের পক্ষ থেকে কুরবানি দিচ্ছেন। একটি সাধারণ ভুল ধারণা হলো—এই বিধান সেই ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য যিনি আসল কুরবানি (জবাই) করছেন। প্রকৃতপক্ষে, এই বিধান প্রযোজ্য সেই ব্যক্তির ওপর যিনি কুরবানির নিয়ত করেছেন, তিনি অন্য কাউকে জবাই করার জন্য দায়িত্ব দিলেও এতে কোনো পার্থক্য হয় না। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর পরিবার ‘আলে মুহাম্মদ’-এর পক্ষ থেকে কুরবানি দিতেন, কিন্তু এমনটি কখনো বর্ণিত হয়নি যে তিনি তাদের চুল বা নখ কাটতে নিষেধ করেছেন।
তবে, যদি কেউ ইচ্ছা করেন এবং পরিবার-পরিজনের উপর এটা বোঝা না হয়, তাহলে তারাও চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকতে পারেন। এটাই ছিল সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব رحمه الله (আবু হুরাইরাহ رضي الله عنه এর জামাতা) ও তাঁর পরিবারের আমল।
কিন্তু যদি কেউ চুল বা নখ কেটে ফেলে, তাহলে সে গুনাহগার হবে এবং তার পুরস্কার কিছুটা হ্রাস পাবে, তবে কুরবানি অবৈধ বা অগ্রহণযোগ্য হবে না।
কুরবানির পশু নির্বাচনের পদ্ধতি
অনেক আলেমের মতে সর্বোত্তম কুরবানি হলো উট, এরপর গরু, এরপর ভেড়া — যদি সম্পূর্ণ পশুটি কুরবানি করা হয়। কিন্তু যদি কারো অংশ (যেমন ১/৭ উট বা গরু) হয়, তাহলে একটি পূর্ণ ভেড়া কুরবানি করা উত্তম।
কেন? এ বিষয়টি নেয়া হয়েছে নিচের হাদিস থেকে যা শুক্রবারে জুমার নামাজ পড়তে আসা ব্যক্তির পুরস্কারের ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“যখন জুমার দিন আসে, ফেরেশতারা মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে যান এবং আগমনের ক্রম অনুযায়ী আগত ব্যক্তিদের নাম লিপিবদ্ধ করতে থাকেন। যে শুরুতেই মসজিদে প্রবেশ করে তার পুরস্কার একটি উট কুরবানি করার মতো, এরপর যে আসে তাদের পুরস্কার গরু, এরপর ভেড়া, এরপর মুরগি এবং এরপর ডিম কুরবানি করার মতো। যখন ইমাম খুতবার জন্য বের হন, তখন ফেরেশতারা তাদের কাগজ গুটিয়ে ফেলেন এবং খুতবা মনোযোগ দিয়ে শোনেন।” [বুখারি]
(অবশ্যই, এটা স্পষ্ট যে কেউ এখন ডিম বা মুরগি কুরবানির দিতে পারবে না—এটা নিছক উদাহরণ মাত্র!)
একটি ভিন্ন মত অনুসারে, সর্বোত্তম কুরবানির পশু হলো ছাগল, কারণ রাসূলুল্লাহ ﷺ ছাগল কুরবানি করেছিলেন।
আবু বকর رضي الله عنه বর্ণনা করেন, যখন ১০ জিলহজ এল, তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর উটের পিঠে উঠলেন এবং এক ব্যক্তি উটের রশি ধরে রাখল। তখন তিনি বললেন:
“তোমরা কি জানো আজ কোন দিন?”
আমরা বললাম: আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন।
রাসূল (ﷺ) চুপ রইলেন এমনভাবে মনে হলো, তিনি দিনটির নাম বদলে দেবেন। তারপর বললেন:
“এটি কি নাহরের দিন (১০ জিলহজ) নয়?”
আমরা বললাম: “আল্লাহর রাসূল, হ্যাঁ।”
তিনি আবার বললেন: “আজ কোন মাস?”
আমরা বললাম: “আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন।”
তিনি বললেন: “এটি কি জিলহজ নয়?”
আমরা বললাম: “হ্যাঁ।”
তিনি বললেন: “এ শহরটির নাম কী?”
আমরা বললাম: আল্লাহ ও তার রাসূল ভালো জানেন। বর্ণনাকারী বললেন, আমরা ভাবলাম তিনি হয়ত এর অন্য কোনো নাম দিবেন এর আসল নাম ছাড়াও।
তিনি বললেন: “এটা কি ‘বালদা’ (মক্কা নগরী) নয়?”
আমরা বললাম: “হ্যাঁ, আল্লাহর রাসূল।”
তারপর তিনি বললেন:
“এই দিন, মাস এবং এই শহর যেমন পবিত্র (হারাম), তোমাদের রক্ত, সম্পদ ও সম্মান তোমাদের পরস্পরের জন্য পবিত্র (হারাম)।”
“যে উপস্থিত আছে, সে যেন অনুপস্থিতকে এই বার্তা পৌঁছে দেয়।”
এরপর তিনি দুটি সাদা-কালো রঙের ভেড়া ও দুটি ছাগল কুরবানি করলেন এবং আমাদের মধ্যে তা বণ্টন করলেন। [মুসলিম]
কোনো ফরজ হাদী বা কুরবানির জন্য এমন পশু কুরবানি করা যথেষ্ট নয়, যা নির্ধারিত বয়স পূর্ণ করেনি।
জাবির رضي الله عنه থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক (‘مُسِنَّة’) পশু কুরবানি করো, যদি কঠিন হয় তাহলে এক বছরের ছোট ও ছয় মাসের উপরে বয়স এমন একটি ভেড়া কুরবানি করো।” [মুসলিম]
একটি পশু “প্রপ্তবয়স্ক” তখনই গণ্য হয় যখন তার সামনের দুটি দাঁত পরিপূর্ণভাবে বের হয়। এটি হতে হবে ছয় মাস বয়সী একটি পুরুষ ভেড়া, অথবা একটি “ثَنِيٌّ” (সানী) বয়সের স্ত্রী ভেড়া। ছাগলের “ثَنِيٌّ” হলো এমন ছাগল যা এক বছর পূর্ণ করেছে। উটের সানী হলো যা পাঁচ বছর পূর্ণ করেছে। গরুর সানী হলো যা দুই বছর পূর্ণ করেছে।
পশুর বয়স সংক্রান্ত ন্যূনতম শর্তসমূহ:
- ছয় মাস বয়সী একটি ভেড়া, যার সামনের দাঁত পড়ে গেছে। একে বলা হয় মা’আয (معز)। এর শরীর সাধারণত উল দিয়ে আবৃত থাকে, লোম দিয়ে নয়।
- এক বছর বয়সী ভেড়া ও ছাগল। একে বলা হয় দান (ضأن)। এর শরীর সাধারণত লোমে আবৃত থাকে এবং পুরুষটির চিবুকে লম্বা লোম থাকে।
- দুই বছর বয়সী গরু ও মহিষ।
- পাঁচ বছর বয়সী উট।
বিভিন্ন মতভেদের ভয়ে নিরাপদ থাকার জন্য এক বছর পার করা একটি ছাগল বা ভেড়া জবেহ করাই উত্তম। একটি ভেড়া একজন ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট। যখন আমরা বলি “একজন ব্যক্তি”, এতে তাঁর পরিবারও অন্তর্ভুক্ত হয়, যারা এই কুরবানির অধীনে তাঁর উপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল।একটি পূর্ণ উট অথবা একটি পূর্ণ গরু যথেষ্ট হয় সাতজন ব্যক্তি বা সাতটি পরিবারের জন্য। কিছু অঞ্চলে প্রচলিত ভুল ধারণা যে মহিষ কুরবানি করা নিষিদ্ধ, মূলত মহিষ কুরবানির জন্য নিষিদ্ধ নয়; বরং এর বিধান গরুর মতই।
উবায়েদ ইবনে ফিরুজ رحمه الله থেকে বর্ণিত: আমি আল-বারা’ ইবন আজিব رضي الله عنه কে জিজ্ঞেস করলাম: “কুরবানির পশুর ক্ষেত্রে কোন ধরনের পশুকে পরিহার করতে হবে?”
তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে— (তাঁর আঙুল দেখিয়ে) বললেন:
চার ধরনের পশুকে কুরবানির জন্য এড়িয়ে চলতে হবে:
- যার এক চোখ নেই বা চোখের স্পষ্ট দৃষ্টি নেই।
- রোগাক্রান্ত পশু, যার রোগ স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
- পঙ্গু পশু, যার ল্যাংড়ানি স্পষ্ট।
- যার হাড়ে মজ্জা নেই, যেমন পা ভাঙা পশু।
তিনি আরও বলেন: আমি যেসব পশুর দাঁতে সমস্যা আছে, সেগুলোকেও অপছন্দ করি। তবে তিনি বললেন: “তোমরা যেটা অপছন্দ করো, সেটা বর্জন করো—কিন্তু কারো জন্য তা নিষিদ্ধ করো না।”
ইমাম আবু দাউদ (রহঃ) বলেন:
“কঙ্কালসার পশু” বলতে বোঝানো হয়েছে এমন পশু যার হাড়ে মজ্জাও নেই।
[সুনান আবু দাউদ]
যে পশুর মধ্যে বড় কোনো ত্রুটি থাকে, যেমন:
- অত্যন্ত কঙ্কালসার (যার মাংস নেই বললেই চলে),
- সম্পূর্ণ অন্ধ বা স্পষ্টভাবে চোখে দৃষ্টি নেই,
- সামনের দাঁত নেই,
- অধিকাংশ কান কাটা,
- শিং ভাঙা,
- বা এমন রোগে আক্রান্ত যা পশুর মাংসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে,
— এমন পশু কুরবানির জন্য উপযুক্ত নয়।
অন্য একটি হাদীসে এসেছে:
- যার কান পুরো কাটা,
- শিং সম্পূর্ণ ভাঙা,
- চোখ উপড়ে গেছে,
- বা এমন দুর্বল যে অন্যান্য পশুর সঙ্গে হাঁটতে পারে না —
এই সব পশুকে অগ্রাহ্য করা হয়, অর্থাৎ এগুলিকে কুরবানির জন্য গ্রহণযোগ্য ধরা হয় না।
কেন?
কারণ আল্লাহর জন্য কুরবানি এমন হতে হবে যা উত্তম, নিম্নমানের বা খারাপ নয়।
হাবিল ও কাবিলের কাহিনী স্মরণ করুন— আদবের (আল্লাহর প্রতি শিষ্টাচার) বিরুদ্ধ কিছু আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
এটি পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর আচরণের একটি অংশ ছিল।
তবে ছোটখাটো আঘাত, যেমন কানের সামান্য ছিদ্র বা ছোট ক্ষত, গ্রহণযোগ্য।
প্রাকৃতিক ত্রুটি ও বৈধ পশুর ধরন
যেসব পশু প্রাকৃতিকভাবে কিছু ত্রুটিসহ জন্মগ্রহণ করেছে, যেমন:
- লেজ নেই,
- শিং নেই,
- খাসি (অন্ডকোষহীন) — তবে শর্ত হলো লিঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় —
এই ধরনের পশুগুলো কুরবানির জন্য বৈধ। যদি কোনো পশু মালিকের অবহেলা ছাড়াই কোনো কারণে ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়ে, তাহলে তাকেও কুরবানি দেওয়া যেতে পারে।
বিশেষ কিছু পরিস্থিতি:
- গর্ভবতী পশু:
যদি কোনো পশু গর্ভবতী হয়, তাহলে তার গর্ভের বাচ্চাটিকেও কুরবানি করতে হবে।
কারণ বাচ্চাটি এখনও জন্মগ্রহণ করেনি, তাই বয়সের হিসাব এখানে প্রযোজ্য নয়। - মুখান্নাছ (উভলিঙ্গ/হিজড়া পশু):
মুখান্নাছ বা হিজড়া প্রকৃতির পশু কুরবানির জন্য জায়েয।
কুরবানির সময় কখন?
কুরবানির সময় শুরু হয় ঈদের নামাজের পরে—ঈদের নামাজ ও খুতবার সময় শুরু হওয়ার সাথে সাথে নয়—এবং তা চলে তাশরিকের দ্বিতীয় দিন পর্যন্ত। এমন স্থানে যেখানে ঈদের নামাজ হয় না, অথবা কোন কারণবশত কেউ নামাজ পড়তে অক্ষম, তখন ঈদের নামাজ পড়ার জন্য যতটুকু সময় লাগে, সেই পরিমাণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর থেকে কুরবানি করার সময় শুরু হয়।
আল-বারা ইবন ‘আজিব رضي الله عنه বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল ﷺ বলেনঃ
“আমরা আমাদের ঈদের দিন শুরু করেছি নামাজ আদায় করে। এরপর আমরা ফিরে গিয়ে পশু জবাই করেছি। যে ব্যক্তি এভাবে করে, সে আমার সুন্নাহর অনুসরণ করেছে। আর যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগে পশু জবাই করেছে, তার জন্য তা শুধু গোশত হিসেবে গণ্য হবে, এবং তা কুরবানির পর্যায়ে পড়বে না।”
এটি আবু বুরদা ইবনে নিয়ার ছিলেন, যিনি ঈদের নামাজের আগেই পশু জবাই করেছিলেন। তিনি বললেন, “আমার কাছে একটি ছোট মেষশাবক আছে, যেটি এক বছরের কম, কিন্তু এক বছরের পশুর চেয়ে বড় ও উত্তম।” তখন রাসূল ﷺ বললেনঃ
“তুমি তা কুরবানি করতে পারো, কিন্তু তোমার পরে আর কারো জন্য তা যথেষ্ট হবে না।”
[মুসলিম]
হাম্বলি মাযহাব অনুযায়ী কুরবানির জন্য ৩ দিন সময় রয়েছে, এবং মাযহাবের দ্বিতীয় অভিমত হচ্ছে ৪ দিন পর্যন্ত সময় রয়েছে। এই দিনগুলো হল—ঈদের দিন, ১১ই যিলহজ্জ এবং ১২ই যিলহজ্জ। ইমাম আহমদ رحمه الله বলেন, এই অভিমত ৫ জন সাহাবা থেকে প্রমাণিত। তবে কেউ যদি প্রয়োজন বা অনুরূপ কোন কারণে ৪র্থ দিনে কুরবানি করে, তাহলেও তার কুরবানি সহীহ হবে।
অতএব, তাশরিকের শেষ দিন, অর্থাৎ ১৩ই যিলহজ্জের সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত কুরবানি করা যাবে। তবে সাবধানতার খাতিরেও উত্তম আদবের কারণে আগেভাগেই কুরবানি করে ফেলা উত্তম—শেষ সময় পর্যন্ত ফেলে রাখা উচিত নয়।
উকবা ইবন ‘আমির رضي الله عنه থেকে বর্ণিত: নবী ﷺ বলেনঃ
“আরাফার দিন, কুরবানির দিন, ও তাশরিকের দিনসমূহ—এই দিনগুলো মুসলমানদের উৎসবের দিন। এই দিনগুলো খাওয়া ও পান করার দিন।”
[আবু দাউদ]
যদি কারো পক্ষ থেকে কুরবানি অন্য দেশে পাঠানো হয়, তবে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, যিনি এই কুরবানির নিয়ত করেছেন, তিনি ঈদের নামাজ শেষ করার আগে যেন ঐ পশু জবাই না হয়। কারণ, উধিয়াহ (কুরবানি) একটি নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সম্পৃক্ত।
যদি এই দিনগুলো সবই মিস হয়ে যায়, তাহলে যেহেতু উধিয়াহর নিয়ত করা হয়েছিল, তাই এখন এই কুরবানি একজন ব্যক্তির জন্য একটি ঋণের মত বকেয়া হয়ে যায়, যা আদায় করা আবশ্যক।
শাইখ ইব্রাহিম নুহু حفظه الله এর মতে, যদি কারো পক্ষ থেকে উধিয়াহ (কুরবানি) অন্য দেশে পাঠানো হয়ে থাকে, এবং যে দেশে কুরবানিদাতা অবস্থান করছেন সেখানে কুরবানির তিন দিন শেষ হয়ে এসেছে বা শেষ হয়ে গেছে, তবুও উধিয়াহ সহীহ গণ্য হবে, যদি ঐ স্থানে (যেখানে কুরবানি করা হচ্ছে) এখনো কুরবানির দিন চলমান থাকে।
এইরকম পরিস্থিতি এড়ানো উত্তম, তবে সময়ের পার্থক্য বা লজিস্টিক সমস্যার কারণে মাঝে মাঝে এমন ঘটে থাকে। ইনশাআল্লাহ, তখনও কুরবানি বৈধ গণ্য হবে।
কিভাবে কুরবানি দেওয়া হয়?
পুরুষ, নারী এবং এমনকি বাচ্চারাও যদি সক্ষম হয়, তাহলে তারা কুরবানি করতে পারে। যদি কেউ নিজের হাতে কুরবানি না করে, তাহলে কুরবানির ইচ্ছা পোষণকারী ব্যক্তির জন্য উত্তম হচ্ছে—তিনি যেন কুরবানির সময় উপস্থিত থাকেন।
আয়শা رضي الله عنها বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আদেশ দিয়েছিলেন যে একটি ভেড়া নিয়ে আসা হোক যার পা, পেট এবং চোখের চারপাশ কালো দাগ ছিল, তিনি তা কুরবানি করবেন। তিনি আয়শাকে বললেন: “আমাকে বড় ছুরিটা দাও,” তারপর বললেন: “এটা পাথরে ধার করো।” তিনি তাই করলেন। এরপর রাসূল (ﷺ) ছুরিটি নিলেন এবং ভেড়াটিকে মাটিতে শুইয়ে কুরবানি করলেন এবং বললেন:
بِاسْمِ اللَّهِ اللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنْ مُحَمَّدٍ وَآلِ مُحَمَّدٍ وَمِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ
“বিসমিল্লাহ, হে আল্লাহ! মুহাম্মদ, মুহাম্মদের পরিবার এবং মুহাম্মদের উম্মতের পক্ষ থেকে (এই কুরবানি) কবুল করে নাও।”
[মুসলিম]
রাসূলুল্লাহ ﷺ কুরবানির সময় পশুটিকে নড়াচড়া থেকে বিরত রাখতে তার গলায় পা রাখতেন। কারণ আনাস رضي الله عنه যিনি রাসূল ﷺ-কে কুরবানি করতে দেখেছিলেন, তিনি এই বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। আর এটি রাসূল ﷺ-এর দয়ার বহিঃপ্রকাশ।
উটের কুরবানি করার সুন্নত পদ্ধতি হলো—তার বাঁ পা বেঁধে রেখে দাঁড়ানো অবস্থায় গলায় নিচের দিক থেকে ছুরি চালানো। অন্য পশুগুলোর কুরবানি করা হয়—তাদের বাম পাশে শুইয়ে, গলার উপরের অংশ থেকে জবাই করে।
ইমাম ইবনু হাজার তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ফাৎহুল বারী-তে বলেন: “উলামাগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, কুরবানির পশুকে তার বাম পাশে শুইয়ে রাখতে হবে। যিনি জবাই করবেন, তিনি পশুর ডান পাশে দাঁড়িয়ে তার উপর পা রাখবেন—এতে তার জন্য ডান হাতে ছুরি ধরা এবং বাম হাতে পশুর মাথা ধরে রাখা সহজ হয়।”
জবাইয়ের পদ্ধতি মূলত দুই প্রকার:
- নাহর (نحر): এ পদ্ধতিতে পশুর লিব্বায় ছুরি ঢোকানো হয় (লিব্বা হলো—গলার গোড়ায় দুই কলারবোনের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান)।
- যাবেহ (ذبح): এটি সবচেয়ে প্রচলিত জবাই পদ্ধতি। এর মাধ্যমে জবাইকারী পশুর গলা কেটে দেয় এবং রক্ত বের হয়ে যায়।
জবাই করার ক্ষেত্রেও কিছু আদাব (শিষ্টাচার) অনুসরণ করা জরুরি—
- পশুটিকে অস্বস্তিতে ফেলা বা ভয় পাইয়ে তোলা যাবে না
- এমন জায়গায় জবাই করা যাবে না, যেখানে অন্য পশুরা তা দেখতে পায়
- পশুটির পরিবারের সামনে তাকে জবাই করা অনুচিত
- কুরবানির আগে পশুকে যথাযথভাবে খাওয়ানো, পান করানো এবং যত্ন নেওয়া উচিত
- ছুরি ভালোভাবে ধারালো করতে হবে
- পশুটির জন্য কাজটি যেন সহজ ও ব্যথাহীন হয় তার জন্য যা কিছু করা যায়, তা করতে হবে এবং যা কিছু কষ্ট বা ভীতি সৃষ্টি করে তা পরিহার করতে হবে
জবাই করার সময় জবাইকারী বলবে:
بِسْمِ اَللَّهِ اَللَّهُمَّ هَذَا مِنْكَ وَلَكَ
“আল্লাহর নামে! হে আল্লাহ! এটি তোমার পক্ষ থেকে এবং তোমার জন্য!”অথবা,
بِسْمِ اللهِ واللهُ أَكْبَرُ اللَّهُمَّ مِنْكَ ولَكَ اللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنِّي
“আল্লাহর নামে, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ! হে আল্লাহ! এটি তোমার পক্ষ থেকে এবং তোমার জন্য। হে আল্লাহ! এটি আমার পক্ষ থেকে কবুল করে নাও।”
[মুসলিম]
জবাইয়ের সময় আল্লাহর নাম নেওয়া আবশ্যক, কারণ আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلَا تَأْكُلُوا۟ مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ ٱسْمُ ٱللَّهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُۥ لَفِسْقٌۭ ۗ وَإِنَّ ٱلشَّيَطِينَ لَيُوحُونَ إِلَىٰٓ أَوْلِيَآئِهِمْ لِيُجَدِلُوكُمْ ۖ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ
“তোমরা সে সকল জিনিস খেয়ো না, যেগুলোর উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়নি। নিশ্চয়ই এটি এক গর্হিত কাজ।”
[সূরাতুল আন’আম, আয়াত ১২১]
আমাদের মাজহাব অনুযায়ী, জবাইয়ের সময় বিসমিল্লাহ বলা ওয়াজিব, তাকবীর এবং একটি দুআ পড়া মুস্তাহাব।
আনাস رضي الله عنه বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ ﷺ দুটি শিংওয়ালা ভেড়া কুরবানি করেছিলেন, যেগুলো ছিল সাদা গায়ে কালো দাগবিশিষ্ট। তিনি নিজ হাতে তাদের কুরবানি করেন, “বিসমিল্লাহ” এবং “আল্লাহু আকবার” (بِسْمِ اللَّهِ وَاللَّهُ أَكْبَر) বলেন এবং তাদের গলায় পা রাখেন।
[বুখারী]
কুরবানির সময় যখন আমরা তাকবীর বলি, তখন আমরা ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের এক অবস্থানে থাকি। উলামাগণ বলেন—আমরা তাকবীর বলি নিজেদের স্মরণ করিয়ে দিতে যে, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ এবং আমাদের উচিত নিজেদের বিনয়ী করা। আমরা এই পশুকে জবাই করতে পারছি কেবল এই কারণে যে, আল্লাহ আমাদেরকে অনুমতি দিয়েছেন এবং পশুকে মানুষের জন্য নিয়ন্ত্রিত করে দিয়েছেন।
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ رحمه الله বলেন:
“জবাই করার সময় খাদ্য ও পানীয়ের পথ (ঘাস), শ্বাসনালী (হালকুম) এবং দুটি শিরা (জগলার ভেইন) কেটে ফেলা জরুরি। তবে সবচেয়ে সঠিক অভিমতের ভিত্তিতে—এই চারটির মধ্যে তিনটি কাটা হলেও জবাই বৈধ হয়ে যায়, সে তিনটির মধ্যে হালকুম থাকুক বা না থাকুক। কারণ, দুটি জগলার ভেইন কেটে ফেলা হালকুম কাটার চেয়ে বেশি কার্যকর এবং রক্ত নিঃসরণের জন্য অধিক যথেষ্ট।”
[আল-ইখতিয়ারাত]
জবাই করার পর পশুর রক্ত সম্পূর্ণরূপে বের হয়ে যাওয়া উচিত। কারণ, এতে পশুর শরীর থেকে অধিকাংশ টক্সিন বের হয়ে যায়। জবাইয়ের পর পশুর হৃদস্পন্দন কয়েক সেকেন্ড চলতে থাকে, যা রক্ত চলাচলকে সহজ করে। পশুটি হয়তো ছটফট করতে পারে, তবে এটি রক্তের ঘাটতিজনিত পেশির সংকোচন ও প্রশমন—ব্যথার কারণে নয়।
এছাড়াও, কুরবানি শেষে আল্লাহর দরবারে দুআ করা এবং তাঁর কাছে এই কুরবানি কবুল করার আবেদন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এটি শিখেছি ইব্রাহিম (عليه السلام) ও ইসমাঈল (عليه السلام) এর নিকট থেকে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَإِذْ يَرْفَعُ إِبْرَاهِيمُ الْقَوَاعِدَ مِنَ الْبَيْتِ وَإِسْمَاعِيلُ رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
“এবং (স্মরণ করুন) যখন ইব্রাহিম কাবাঘরের ভিত্তি স্থাপন করছিলেন এবং তার সাথে ছিলেন ইসমাঈল। তারা বলছিলেন: ‘হে আমাদের রব! আমাদের পক্ষ থেকে (এ কাজ) কবুল করে নিন। নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’”
[সূরা বাকারাহ, আয়াত ১২৭]
কিভাবে কুরবানির মাংস বণ্টন করা হয়?
উধিয়াহর (কুরবানির) মাংস তিন ভাগে ভাগ করা মুস্তাহাব (recommended):
- নিজে খাওয়ার জন্য
- উপহার দেওয়ার জন্য
- সদকা (দান) করার জন্য
প্রথম ভাগটি কুরবানি প্রদানকারী নিজে রাখবেন ও খাবেন। দ্বিতীয় ভাগটি পরিবার-পরিজন বা বন্ধুবান্ধবকে উপহার হিসেবে দিবেন। তৃতীয় ভাগটি গরীব, ক্ষুধার্ত এবং অসহায়দের মাঝে সদকা করবেন। এই মতামতের পক্ষে ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ ও ইবনু উমর رضي الله عنهما।
সুন্দর শিষ্টাচার হলো—সবচেয়ে উত্তম মাংস গরীবদের সদকা দেওয়া, তার পরের অংশ উপহার দেওয়া, এবং বাকি অংশনিজে খাওয়া।
চাইলেই কেউ পুরো মাংস নিজে খেতে পারেন। তবে, অন্তত কিছু অংশ সদকা করা উচিত—যাতে কুরবানির তাৎপর্য বজায় থাকে। হাম্বলি মাজহাব অনুযায়ী, কমপক্ষে কিছু পরিমাণ ‘লাহম‘ (মাংস) দান করা আবশ্যক।
এই ন্যূনতম পরিমাণ কী?
এটি স্থান ও সংস্কৃতিভেদে ভিন্ন হতে পারে। কিছু হাম্বলি আলেম বলেন, এই পরিমাণ কমপক্ষে এক উকিয়াহ, যা সমান ১৪ দিরহাম রূপার (প্রায় ১১৯ গ্রাম রূপা)।
তবে শাইখ মারি’ আল-কারমি رحمه الله তাঁর গ্রন্থ দালীল আত-তালিব-এ বলেন: সংখ্যাগত নির্দিষ্টতা নয়, বরং ‘লাহম’ হিসেবে গণ্য হয় এমন পরিমাণই আবশ্যক।
মাংস অমুসলিমদেরকেও দেওয়া যেতে পারে— এতে কোনো আপত্তি নেই।
বিক্রি নিষিদ্ধ:
কুরবানির মাংস, চর্বি, চামড়া—কোনো কিছুই বিক্রি করা জায়েজ নয়।
কসাই বা জবাইকারীকে কুরবানির অংশ থেকে কোনো পারিশ্রমিক বা পুরস্কার হিসেবে কিছু দেওয়া যাবে না, এমনকি চামড়াও না। বরং, এই জিনিসগুলো বিক্রি না করে উপকারমূলকভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
কেন?
কারণ, এটি বিশুদ্ধভাবে আল্লাহর জন্য কৃত ইবাদত। একে লেনদেনের পণ্য বানানো অনুচিত এবং মাজহাব অনুযায়ী হারাম।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“যে ব্যক্তি কুরবানির চামড়া বিক্রি করে, তার কুরবানি নেই (অর্থাৎ তার কুরবানি গ্রহণযোগ্য নয়)।”
[সহীহ আল-জামি’]
আলী رضي الله عنه বলেন:
“আল্লাহর রাসূল ﷺ আমাকে কুরবানির দায়িত্ব দিলেন, এবং আদেশ করলেন—এর মাংস, চামড়া ও আবরণ সদকা করতে। এবং কসাইকে পারিশ্রমিক হিসেবে কুরবানির পশুর কিছু না দিতে। তিনি বললেন:‘আমরা তাকে আমাদের পক্ষ থেকে কিছু দেব।'”
[বুখারি ও মুসলিম—মুত্তাফাকুন ‘আলাইহ]
আমি কি কুরবানির পরিবর্তে পশুর দাম দিয়ে দিতে পারি?
উধিয়াহ (কুরবানি) ইসলাম ধর্মের একটি প্রতীক, যেমন আযান বা সালাত। এগুলোর মতোই এটি অবিচ্ছিন্নভাবে পালনযোগ্য—উম্মাহকে এর চর্চা চালিয়ে যেতে হবে। এখানে কুরবানির ফরজ বা সুন্নত হওয়া নিয়ে নয়, বরং এই আমলের ধারাবাহিকতা সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম رحمه الله বলেন:
“যেখানে কুরবানি নির্ধারিত হয়েছে, সেখানে কুরবানি করাই উত্তম, কুরবানির সমপরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি অর্থ সদকা করলেও সেটা কুরবানির কাজের সমতুল্য নয়। যেমন, হজের সময় ও ঈদুল আজহার কুরবানি—এর উদ্দেশ্যই হল পশু জবাই করা এবং রক্ত প্রবাহিত করা। এটি এমন একটি ইবাদত যা সালাতের সাথে একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন: ‘অতএব তোমার রবের জন্য সালাত আদায় করো এবং কুরবানি করো'”
[সূরা কাওসার: ২]
শাইখ ইবনু উথাইমিন رحمه الله বলেন:
“কুরবানির পশু জবাই করা সদকা দেওয়ার চেয়ে উত্তম, কারণ এটাই রাসূলুল্লাহ ﷺ এবং তাঁর সাহাবিরা করেছেন। কুরবানি ইসলামের একটি নিদর্শন। যদি মানুষ কুরবানি না করে কেবল দান করে, তাহলে এই নিদর্শন বিলুপ্ত হয়ে যাবে।”
আমাদের শাইখ ইব্রাহীম নূহু حفظه الله বলেন:
“উধিয়াহ ইসলামের নিদর্শনগুলোর একটি। এটি সরাসরি গরীবদের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, কারণ কেউ চাইলে সবটুকু মাংস নিজে খেতেও পারে, কিছু সদকা না করেও। তাই সরকারের কর্তব্য এই নিদর্শনগুলো রক্ষা করা। কুরবানির পরিবর্তে কেবল অর্থ প্রদান করা—এই ধারণা ধর্ম পরিবর্তনের শামিল। যদি আমরা দেখি যে দেশ-১ থেকে সব পশু দেশ-২ এ পাঠানো হচ্ছে এবং দেশ-১-এ কোনো পশু জবাইই হচ্ছে না, তবে এটি স্পষ্টতই ভুল। পশু দেশ-১-এ জবাই করতে হবে এবং অতিরিক্ত অংশ প্রয়োজনে দেশ-২ তে পাঠানো যেতে পারে। যদি আপনার সামনে কেউ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থাকে, তাহলে তাকে টাকা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু যদি আপনি দুনিয়া ঘুরে গরীব খুঁজতে থাকেন, তাহলে কেউ কখনো কুরবানি দেবে না—এবং এটি ভুল।”
যদি কুরবানির জন্য টাকা না থাকে তাহলে কী করব?
একজন ব্যক্তি কুরবানি দেওয়ার জন্য ঋণ নেওয়া বা দেনায় পড়া উচিত নয়। কুরবানি শুধুমাত্র তাদের জন্য যারা তা করতে সক্ষম এবং নিজেদের ও পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ রাখে। এমনকি যেসব আলেম উধিয়াহ/কুরবানিকে ওয়াজিব মনে করেন, তারাও বলেন—সামর্থ্য অর্জন না হলে এটি করা জরুরি নয়।
কেন?
আমাদের শাইখ ইব্রাহীম নূহু حفظه الله বলেন:
“ঋণ একটি অত্যন্ত গুরুতর বিষয়। এমনকি কারো সব গুনাহ মাফ হয়ে গেলেও, ঋণ মাফ হয় না। প্রথমে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছিলেন, সব গুনাহ মাফ হবে। তখন জিবরীল আলাইহিস সালাম নেমে এসে শুধুমাত্র এই একটি বিষয় সংশোধন করতে এলেন—ঋণ মাফ হবে না, কারণ এটি অন্যের হক। এটি ক্ষমার অযোগ্য। এতে বোঝা যায়, ঋণের বিষয় কতটা স্পর্শকাতর। রাসূল ﷺ এমন লোকের জানাজা পড়াতেন না যার ওপর মাত্র ৩ দিনারের ঋণ ছিল। এমন লোকদের কবরে অন্ধকার নেমে আসে। শুধুমাত্র ঋণ পরিশোধ হলে মৃত ব্যক্তির চামড়া ঠান্ডা হয়। আখিরাতে কোনো রিয়াল বা রিঙ্গিত থাকবে না, শুধু থাকবে আমলনামা। দুনিয়ার ১ রিয়ালের ঋণ আখিরাতে এক পাহাড় পরিমাণ নেকির সমান হয়ে যেতে পারে। এরচেয়েও খারাপ বিষয় হল—সেদিন কারো জন্য কোনো ছাড় থাকবে না, সবাই শুধু নিজের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং লাভে আসতে চাইবে। তাই জেনে শুনে এমন পরিস্থিতিতে পড়বেন না এবং পড়লে সাথে সাথে চেষ্টা করুন পরিশোধ করার।”
আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস رضي الله عنه থেকে বর্ণিত:
রাসূলুল্লাহ ﷺ এক ব্যক্তিকে বললেন:
“আমাকে আদেশ করা হয়েছে কুরবানির দিনকে ঈদ হিসেবে পালনের জন্য, যেটি আল্লাহ তাআলা এই উম্মাহর জন্য নির্ধারণ করেছেন।”
তখন সেই ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল:
“আপনি কী বলেন, যদি আমার কাছে কিছু না থাকে, কেবল একটি ঋণে নেওয়া দুধদানে উপযোগী ভেড়া ছাড়া? আমি কি সেটিকে কুরবানি করতে পারি?”
তিনি বললেন:
“না। বরং তোমার চুল ও নখ কেটে ফেলো, গোঁফ ছোট করো এবং লজ্জাস্থানের চুল পরিষ্কার করো। এর দ্বারা তোমার পূর্ণ সওয়াব হবে এবং আল্লাহর নিকট তুমি কুরবানি করেছো বলে গণ্য হবে।”
[নাসাঈ]
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“যখন শুক্রবার আসে, তখন ফেরেশতারা মসজিদের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে যায় এবং আগমনের ক্রমানুসারে আগতদের নাম লিখে যেতে থাকে। যে ব্যক্তি প্রথম প্রহরে মসজিদে প্রবেশ করে, সে যেন একটি উট কুরবানি করে। তারপর যার পরেই আসে সে যেন একটি গরু কুরবানি করে, তারপর একটি ভেড়া, এরপর একটি মুরগি এবং সর্বশেষে একটি ডিম। যখন ইমাম বের হন (জুমার খুতবার জন্য), তখন ফেরেশতারা তাদের নামের খাতা গুটিয়ে ফেলে এবং খুতবা শুনতে থাকে।”
[বুখারি]
দ্বিতীয়ত, আমরা জানি ইসলাম ধর্মে নিয়তের গুরুত্ব কত বেশি এবং কীভাবে এটি সম্পূর্ণ বিষয়টিকে বদলে দিতে পারে। এখন দেখুন নিয়তের মাধ্যমেও একজন মানুষ কিভাবে অপার সওয়াব অর্জন করতে পারে।
আবূ কাবশাহ ‘আমর ইবনু সা‘দ رضي الله عنه থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“আমি আল্লাহর কসম করে তিনটি বিষয় তোমাদের জানাচ্ছি—সেগুলো ভালোভাবে মনে রেখো:১. “সাদাকাহ দিলে কারো সম্পদ হ্রাস পায় না।”
২. “যে ব্যক্তি তার প্রতি কোনো অন্যায়ে ধৈর্য ধারণ করে, আল্লাহ তাকে সম্মান দান করেন।”
৩. “যে ব্যক্তি ভিক্ষার দরজা খোলে, আল্লাহ তার জন্য দারিদ্র্যের দরজাও খুলে দেন (অথবা তিনি অনুরূপ কিছু বলেছেন)।”এরপর তিনি ﷺ বলেন:
“এটাও ভালো করে মনে রেখো—দুনিয়াতে মানুষ চার শ্রেণির:”১. সেই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ সম্পদ ও জ্ঞান দিয়েছেন— ফলে সে তার রবকে ভয় করে, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে, এবং আল্লাহর হক আদায় করে— এ ধরনের ব্যক্তি জান্নাতে সর্বোত্তম অবস্থানে থাকবে।
২. সেই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ জ্ঞান দিয়েছেন কিন্তু সম্পদ দেননি— সে তার নিয়তে একনিষ্ঠ এবং সে বলে: “যদি আমার কাছে সম্পদ থাকত, আমি অমুকের মতোই ব্যবহার করতাম।” যদি তার নিয়ত সত্য হয়, তাহলে সে ব্যক্তিও ঐ ব্যক্তির মতোই সওয়াব লাভ করবে যার সম্পদ আছে এবং এর উত্তম ব্যবহার করে।
৩. সেই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন কিন্তু জ্ঞান দেননি— সে অজ্ঞতার সাথে সম্পদ অপচয় করে, আল্লাহকে ভয় করে না, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে না, এবং আল্লাহর হক আদায় করে না— এই ব্যক্তি আখিরাতে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকবে।
৪. সেই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ না জ্ঞান দিয়েছেন, না সম্পদ— সে বলে: “যদি আমার কাছে সম্পদ থাকত, আমি অমুকের মতোই অপচয় করতাম (টাকা উড়াতাম)।” যদি তার নিয়ত এইরকম হয়, তবে তারা উভয়েই সমানভাবে গুনাহগার হবে।
[তিরমিযি]
আমি কি আকিকা ও কুরবানির নিয়ত একত্র করতে পারি?
আকিকার ক্ষেত্রে, আমরা দেখি যে রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য একটি করে সম্পূর্ণ পশু জবাই করার আদেশ দিয়েছিলেন। আমরা এমন কোনো হাদীস পাই না যেখানে আকিকার জন্য উট ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে। এটি তাঁর পক্ষ থেকে একটি স্পষ্ট আদেশ ও আমল, এবং আমরা শুধু সেই পশুগুলোতেই সীমাবদ্ধ থাকি যা তিনি নির্দেশ করেছেন।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “ছেলের জন্য দুটি ছাগল, আর মেয়ের জন্য একটি ছাগল এবং তাতে পুরুষ বা নারী (ছাগল) হওয়াতে কোনো সমস্যা নেই।” [বুখারি]
আয়িশা رضي الله عنها থেকে বর্ণিত, “আল্লাহর রাসূল ﷺ আদেশ দিয়েছিলেন যেন ছেলের জন্য দুটি এবং মেয়ের জন্য একটি ছাগল তাদের জন্মের সময় জবাই করা হয়।” [তিরমিজি]
আলী ইবনু আবি তালিব رضي الله عنه বলেন, “আল্লাহর রাসূল ﷺ আল-হাসানের আকিকা করেছিলেন একটি ছাগল দ্বারা এবং বলেছিলেন: ‘হে ফাতিমা! তাঁর মাথা মুণ্ডন করো এবং তাঁর চুলের ওজন অনুযায়ী রূপা সদকা করো।’”
তিনি বলেন: “আমি তা ওজন করেছিলাম এবং তা ছিল এক দিরহাম অথবা এক দিরহামের কিছু কম।”
[তিরমিজি]
শাইখ ইবন উসাইমিন رحمه الله বলেছেন, “একটি ছাগল একটি পূর্ণ উটের চেয়ে উত্তম, কারণ এটি সুন্নাহতে বর্ণিত হয়েছে, তাই এটি একটি উটের চেয়ে উত্তম।” [শারহ আল-মুমতি’]
আমরা সাহাবাদের আমল থেকে এমন কোনো সহীহ রেওয়ায়েত পাই না যা থেকে বোঝা যায় যে তাঁরা গরু বা উটের অংশ দিয়ে আকিকা করে নিয়েছেন। বরং, তাঁরা একটি সম্পূর্ণ পশু জবাই করতেন।
এই বিষয়ে কিছু আলেমের মতভেদ রয়েছে। মালিকি এবং কিছু শাফি’ই ও হানাবিলা আলেম বলেছেন যে দুইটি ইবাদতের নিয়ত একত্র করা শুদ্ধ নয়, কেননা এগুলো আলাদা আলাদা ইবাদত।
যেহেতু বিষয়টি দুটি পৃথক রক্ত প্রবাহিত করার ইবাদত তাই এটি আলাদা আলাদাভাবে সম্পন্ন করা জরুরি, একত্রে করা যাবে না। অনেক আলেমের মতে, কুরবানি ও আকিকা পৃথকভাবে ওয়াজিব আমল, তাই একত্র করা যাবে না। হাদীসগুলোও ইঙ্গিত করে যে আকিকা হল এক প্রকার মুক্তিপণ যা নবজাতকের জন্য জবাই করা হয়। এটি হতে হবে প্রতি প্রাণের জন্য একটি প্রাণ — আর তাই, এটি কুরবানির সাথে একত্র করা যায় না।
তাঁরা এ বিষয়ে একে তুলনা করেছেন হজে তামাত্তু’ পালনকারী হাজীর কুরবানির সাথে, যেখানে কেউ ফিদিয়া হিসেবে আরেকটি কুরবানি করে, তখন একটি কুরবানিকে অপরটির বিকল্প হিসেবে গণ্য করা যায় না বা নিয়ত একত্র করা যায় না।
অন্যদিকে, হানাফি আলেমগণ, ইমাম আহমদ رحمه الله -এর একটি মত এবং হাসান আল-বাসরি رحمه الله -এর মতো আলেমগণ দুইটি নিয়ত একত্র করার অনুমতি দিয়েছেন। তাঁরা এই বিষয়টিকে সেই বিষয়ের মতো মনে করেছেন যেখানে জুমু’আ ও ঈদ একই দিনে পড়ে এবং একটি সালাত আদায় করাই অপরটির জন্য যথেষ্ট হয়।
তবে, ধরুন কেউ আকিকার জন্য গরু বা উট জবাই করার অনুমতি দিল, তখন কীভাবে আমরা নিশ্চিত হব যে একটি গরু বা উটের ১/৭ ভাগ আকিকার জন্য যথেষ্ট? এর জন্য আমাদের উধিয়ার উপর কিয়াস করতে হয়। যেহেতু সুন্নাহতে একটি সম্পূর্ণ পশু নির্ধারিত হয়েছে, তাই এমনকি যারা একত্র নিয়তের অনুমতি দেন, তাঁদের মধ্যেও মতভেদ আছে। অনেক হানাবিলা বলেন, একটি পূর্ণ গরু বা উট একটি ব্যক্তির আকিকার জন্য জবাই করতে হবে। পুরুষ সন্তানের জন্য তাহলে ২টি গরু বা উট লাগবে।
যদি কেউ উভয়টাই (উধিয়াহ ও আকিকা) করার আর্থিক সামর্থ্য না রাখে, তাহলে ঈদের দিনে কুরবানির কাজটি করা আবশ্যক, আর আকিকা সামর্থবান হলে পরে করতে হবে, কারণ কুরবানি সময়-সংবেদশীল আমল।
এক কথায়, নিরাপদ পন্থায় থাকা উত্তম এবং আমাদের আলেমদের মাঝে বিদ্যমান মতভেদের বাইরে থাকা উচিত নয়। এই দুইটি নিয়ত একত্র করা যাবে না, এবং গরু বা উটের অংশ নিয়ে আকিকা হিসেবে উৎসর্গ করাও জায়েয নয়। উভয় আমল আলাদাভাবে সম্পন্ন করা আবশ্যক।
এই মতটি আমাদের উস্তাদগণের—শাইখ ড. ইব্রাহিম নূহু, শাইখ ড. মাহবুব আবু আসিম, শাইখ জাফাউল হাসান মাদানী, শাইখ ড. ওবায়দুল্লাহ রহমান মাদনী, শাইখ মুহাম্মদ মুনীর কামার, এবং অন্যদের।
No Comment! Be the first one.