আল্লাহ কুরআনকে আমাদের সাথে কথা বলার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আমাদের অনেকেই ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি যে কুরআন একটি পবিত্র গ্রন্থ, যাতে অনেক আদেশ-নিষেধ রয়েছে। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি এই কিতাব আসলে কী এবং এতে কী রয়েছে? কুরআন কী? কুরআন কীভাবে সংরক্ষিত হয়েছে? কুরআন কীভাবে গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়েছে? কুরআনের জ্ঞানীয় শাখা বলতে কী বোঝায়? এই শাখাসমূহ কীভাবে উদ্ভব হয়েছে এবং কীভাবে তা ছড়িয়ে পড়েছে?
কুরআন কী?
আল্লাহ আমাদের সাথে কথা বলার মাধ্যম হিসেবে কুরআনকে বেছে নিয়েছেন। আমাদের অনেকেই কুরআনকে একটি পবিত্র কিতাব হিসেবে জানি, যাতে অনেক নির্দেশনা এবং নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু আমরা কি জানি, এই কিতাব আসলে কী এবং এতে কী রয়েছে?
আলিমগণ পবিত্র কুরআনের সংজ্ঞা এভাবে দিয়েছেন:
كلامُ اللهِ المنزّلُ على نبيّهِ محمّدٍ ﷺ، المعجزُ بلفظهِ، المتعبّدُ بتلاوتهِ، المنقولُ إلينَا بالتّواترِ، المبدوءُ بسورةِ الفاتحةِ، والمختومُ بسورةِ النّاسِ.
আল্লাহর সেই কালাম, যা তিনি তাঁর নবী মুহাম্মদ ﷺ – এর উপর নাজিল করেছেন, যা শব্দে নকল করা অসম্ভব, যা ইবাদতের উদ্দেশ্যে তিলাওয়াত করা হয়, যা এক বিশালসংখ্যক বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীদের দ্বারা আমাদের কাছে পৌঁছেছে, যা সূরাহ ফাতিহা দিয়ে শুরু হয়েছে এবং সূরাহ নাস দিয়ে শেষ হয়েছে।
চলুন এটাকে একটু বিশ্লেষণ করি:
১. আল্লাহর কালাম: অর্থাৎ, এটি শুধুমাত্র আল্লাহর নিজস্ব কথা, এতে তার সৃষ্টি হোক — মানুষ, জিন বা ফেরেশতা — অন্য কারো কোনো বক্তব্য নেই।
২. নাজিল করা হয়েছে: এটি এমন কালামের কথা, যা আল্লাহ মুহাম্মদ ﷺ -এর উপর অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহর অন্যান্য কালাম যা তিনি কারো উপর অবতীর্ণ করেননি কিংবা নিজের কাছে রেখেছেন, সেগুলো কুরআনের অন্তর্ভুক্ত নয়।তবে আল্লাহর বক্তব্য শুধুমাত্র কুরআনে যা নাজিল করেছেন তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।।
৩. তাঁর নবী মুহাম্মদ ﷺ –এর উপর: এর মানে কুরআন শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর উপর নাজিল হয়েছে। এর দ্বারা অন্যান্য নবীদের উপর নাজিলকৃত কিতাব যেমন — তাওরাত, ইনজিল এবং যবূরকে বোঝানো হয় না।
৪. যা শব্দে শব্দে নকল করা অসম্ভব: এর মানে কেউ কখনো এর মতো কিছু বানাতে পারবে না। এটি কুরআনের অন্যতম অলৌকিক বৈশিষ্ট্য। কেউ সম্পূর্ণ এর মতো কিছু আনতে পারবে না, এমনকি এর সবচেয়ে ছোট সূরার অনুরূপ কিছুও না।
৫. যা ইবাদতের অংশ হিসেবে তিলাওয়াত করা হয়: সালাতে এটি তিলাওয়াত করার নির্দেশ রয়েছে এবং অন্যান্য ইবাদতেও এটি পাঠ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সুতরাং, একক বর্ণনার কিরাআতقِرَاءَةُ الآحاد) [1]) বা হাদীসে কুদসিকে [2] এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না, কারণ সেগুলো ইবাদতের অংশ হিসেবে তিলাওয়াত করা বৈধ নয়।
৬. যা বিশাল সংখ্যক বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের দ্বারা ধারাবাহিকভাবে আমাদের কাছে পৌঁছেছে: এর অর্থ হলো, এটি আমাদের কাছে পৌঁছেছে একদল লোকের মাধ্যমে যারা অন্য একদল লোক থেকে পেয়েছে এবং এই পদ্ধতিতে ধারাবাহিকভাবে চলে এসেছে। এতো বিশাল সংখ্যক লোকের পক্ষে মিথ্যার উপর একমত হওয়া অসম্ভব। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এইরূপ ধারাবাহিক বর্ণনার মাধ্যমে তারা আমাদের কাছে এই কুরআনকে পৌঁছে দিয়েছে। প্রথম দলটি সরাসরি রাসূলুল্লাহ ﷺ – এর কাছ থেকে কুরআন তিলাওয়াত শুনেছিলেন এবং যেমন শুনেছিলেন ঠিক তেমনিভাবে পরবর্তী দলের কাছে তা পৌঁছে দিয়েছিলেন এবং এইভাবে কুরআন অবিকৃত অবস্থায় আমাদের পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে।
৭. যা সূরাহ ফাতিহা দিয়ে শুরু হয়েছে,
৮. এবং সূরাহ নাসে শেষ হয়েছে।
الفصول الحسان في علوم القرآن – (আব্দুল্লাহ বিন সাইফ আল-আজদি)
উলূমুল কুরআন (Ulumul Qur’an) কী?
কুরআনকে ভাবুন এক বিশাল সাগরের মতো। এর জ্ঞান অফুরন্ত এবং এ জ্ঞানের নৌকায় চড়ে যিনি যাত্রা শুরু করেন, তাঁর ওপর নির্ভর করে তিনি কতদূর যেতে চান— চাইলে কখনও প্রশান্ত, আবার কখনও গভীর তরঙ্গময় ঢেউয়ের মাঝে বিচরণ করতে পারেন। উলূমুল কুরআন (Ulumul Qur’an) বা কুরআনের জ্ঞানের শাখাসমূহ কুরআনের সঙ্গে সম্পর্কিত একক কোনো শাস্ত্র নয়। বরং এটি এমন সকল শাস্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করে, যা কুরআনের জন্য সহায়ক অথবা কুরআনের ভিত্তিতে গঠিত।
উলূমুল কুরআনের অন্তর্ভুক্ত শাস্ত্রগুলো হলো:
التفسير(তাফসীরের জ্ঞান)
القراءات (কিরাআতের জ্ঞান)
علم الرسم (কুরআনের লেখনরীতি বা স্ক্রিপ্টের জ্ঞান)
الإعجاز (কুরআনের মু‘জিযা বা অলৌকিকত্ব)
أسباب النزول (আয়াত নাজিলের কারণসমূহ)
الناسخ والمنسوخ (নাসিখ ও মানসুখ আয়াত ) [3]
غريب القرآن(কুরআনের অপ্রচলিত/অপরিচিত শব্দাবলী)
إعراب القرآن (কুরআনের আরবী ব্যাকরণগত বিশ্লেষণ বা ই’রাব)
উলূমুল কুরআন কেবল উপরোক্ত বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি বহু শাস্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করে। ইমাম আস-সুয়ূতী তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইত্বকান ফি উলূমিল কুরআন’ (Itqan fi Ulum al-Qur’an)-এ কুরআনের ৮০টিরও বেশি শাখা লিপিবদ্ধ করেছেন।
উলুমুল কুরআনের (কুরআনের শাস্ত্রসমূহের) উদ্ভব ও বিস্তার কীভাবে ঘটেছে?
রসূলুল্লাহﷺ হলেন উলুমুল কুরআনের প্রথম শিক্ষক। কারণ, তিনি কুরআন এবং তার শাস্ত্রসমূহ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জ্ঞান রাখতেন, কেননা তিনি সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি লাভ করতেন। তিনি সাহাবীদের শুধু আল্লাহর নাযিলকৃত আয়াতসমূহই পৌঁছে দেননি, বরং নিজের সুন্নাহ—অর্থাৎ বাণী, কর্ম, মৌনসম্মতি ও বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে কুরআনকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণও করে দিয়েছেন। তিনি যখন সাহাবীদের নাযিলকৃত আয়াতসমূহ শোনাতেন, তখন সেই আয়াতে থাকা বিধান, উপদেশ, সূক্ষ্ম অর্থ ও দিকনির্দেশনাগুলোও ব্যাখ্যা করতেন।
সাহাবাগণ এই জ্ঞান তাঁর থেকে গ্রহণ করতেন এবং তা মুখস্থ করে নিতেন। তাদের জন্য এটা সহজ ছিল, কারণ তারা ছিল আরব, আর তাদের স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। সে সময়ের আরবদের স্বভাবই ছিল হাজার হাজার কবিতার চরণ ও বিভিন্ন গোত্রের বংশপরিচয় মুখস্থ রাখা। তাই, তাঁরা রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে এই মহামূল্যবান কুরআনিক জ্ঞান লাভ করেন এবং কখনো তা লেখার প্রয়োজন বোধ করেননি—তারা মুখস্থ করার মাধ্যমেই তা সংরক্ষণ করতেন। যদিও এমন বহু সহীহ সূত্র আছে যেগুলো প্রমাণ করে যে, নবী ﷺ –এর সময়েই কুরআন পশুর চামড়া, হাড়, খেজুর পাতার খোল ও পাথরের টুকরোতেও লেখা হতো।
যায়দ ইবন সাবিত رضي الله عنه বলেছেন, “রসূলুল্লাহ ﷺ যখন ইন্তিকাল করেন, তখনো কুরআন একত্রিত করা হয়নি। এটা খেজুর গাছের ডাল, গাছের গুঁড়ি, পাতা ইত্যাদিতে লেখা ছিল।” [ফাযায়েল আস-সাহাবা]
এটা জানা জরুরি যে, সাহাবিরা আজ আমরা যে কুরআনিক শাস্ত্রসমূহ জানি তার সবকিছুই রসূলুল্লাহ ﷺ থেকে জেনেছেন। আজ আমাদের হাতে যা আছে, সাহাবিদের এসব কিছু অজানা ছিল না। তাঁরা নবী ﷺ –এর কাছ থেকে শিখেছেন এবং ইসলামের সৌন্দর্য ও কুরআনের শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছেন। তাদের জ্ঞানের প্রচার তখনো মুখে মুখেই হতো, লেখালেখির মাধ্যমে নয়। এই পদ্ধতি নবী ﷺ এর ইন্তিকালের পরও আবু বকর ও উমর رضي الله عنهما –এর খিলাফতের সময় পর্যন্ত বজায় ছিল।
নবী ﷺ –এর ইন্তিকালের পর প্রথম কুরআন সংকলন করেছিলেন আবু বকর رضي الله عنه ইয়ামামার যুদ্ধে ৭০ জন কুরআন জানা সাহাবি শহীদ হওয়ার পর, উমর رضي الله عنه –এর পরামর্শে। উমর বলেছিলেন, “ইয়ামামার যুদ্ধে অনেক ক্বারী শহীদ হয়েছেন, আমি আশঙ্কা করি অন্য যুদ্ধে আরও ক্বারীগণ শহীদ হবেন এবং কুরআনের একটি বড় অংশ হারিয়ে যেতে পারে। তাই আমার মতামত হচ্ছে, আপনার কুরআন সংকলনের আদেশ দেয়া উচিত।” [বুখারী]
যায়দ ইবন সাবিত رضي الله عنه রাসূলুল্লাহ ﷺ –এর কুরআন তিলাওয়াত শুনতেন এবং তিনি নবী ﷺ –এর ইন্তিকালের পূর্বে তাঁর সর্বশেষ তিলাওয়াতও শুনেছিলেন। বর্ণিত হয়েছে যে, এই শেষ তিলাওয়াতে সূরাগুলোর ক্রম, নাসিখ ও মানসুখ আয়াত, এবং অন্যান্য বিষয়াবলি পরিষ্কারভাবে নির্ধারিত হয়েছিল। তাই আবু বকর رضي الله عنه তাঁকে কুরআন সংকলনের দায়িত্ব দেন। বর্ণিত হয়েছে, আবু বকর رضي الله عنه বলেন, “তুমি একজন প্রজ্ঞাবান যুবক, আমরা তোমার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ করি না, এবং তুমি আল্লাহর রাসূল ﷺ –এর ওহী লেখক ছিলে।” [বুখারী]
যায়দ ইবন থাবিত رضي الله عن বলেন, “আমি কুরআনের ওহি লিখে দিতাম যেমন নবী ﷺ আমাকে তিলাওয়াত করে শুনাতেন, আর যখন আমি লেখা শেষ করতাম, তিনি বলতেন, ‘পড়ো।’ আমি তা পড়তাম, যদি কোনো ভুল থাকত, তিনি তা সংশোধন করে দিতেন। এরপর আমি লোকদের কাছে যেতাম এবং তা উপস্থাপন করতাম।” [তাবারানী]
ইমাম আস-সুলামী رحمه الله বলেন, “যায়দ নবী ﷺ –কে মৃত্যুর বছরে কুরআন দুইবার তিলাওয়াত করে শুনিয়েছিলেন এবং এটাই ছিল আল-আরদাহ আল-আখিরাহ। এটি যেহেতু নবীর সামনে পাঠ ও লিখিত হয়েছিল এবং তিনিই মানুষকে শেখাতেন, তাই আবু বকর ও উমর তাঁকেই কুরআন সংকলনের দায়িত্ব দেন এবং উসমান তাঁকে মুসহাফ লেখার দায়িত্ব দেন—আল্লাহ তাঁদের সবার প্রতি সন্তুষ্ট হোন।” [শারহ আস-সুন্নাহ]
সকল সাহাবাদের বলা হয়েছিল তাদের কাছে থাকা আয়াতসমূহ নিয়ে আসার জন্য। কোনো আয়াত তখনই সংকলিত হতো যখন অন্তত দু’জন তা সাক্ষ্য দিত। শুধু খুযাইমাহ ইবন সাবিত رضي الله عنه –এর ব্যাপারে ব্যতিক্রম ছিল, কারণ নবী ﷺ তাঁর সাক্ষ্যকে দুইজনের সমান বলেছেন।
আলি ইবন আবু তালিব رضي الله عنه বলেন, “আল্লাহ আবু বকরের প্রতি রহম করুন। তিনিই প্রথম কুরআনকে দু’মলাটে সংকলন করেছিলেন।” [মুসান্নাফ ইবন আবি শাইবাহ] এই মুসহাফ ছিল আবু বকরের কাছে, এরপর উমরের, তারপর হাফসার কাছে, অবশেষে উসমান এটি নিয়ে স্ট্যান্ডার্ড মুসহাফ প্রস্তুত করেন। আল্লাহ তাঁদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট হোন।
ইমাম আল-লায়স ইবন সা‘দ رحمه الله বলেন, “প্রথম কুরআন সংকলন করেছিলেন আবু বকর, আর যায়দ তা লিপিবদ্ধ করেন। লোকেরা যায়দের কাছে আসতেন, আর তিনি কোনো আয়াত লিখতেন না যতক্ষণ না দুইজন সাক্ষ্য দিত।” [আল-ইতকান]
উসমান رضي الله عنه – এর সময়ে, যখন ইসলামের বার্তা দ্রুত মহাদেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল এবং ইসলামী সাম্রাজ্য ব্যাপকভাবে প্রসারিত হচ্ছিল, তখন উসমান رضي الله عنه ও সাহাবায়ে কিরাম অনুভব করলেন যে, কুরআনকে একটি একক মুসহাফে সংকলিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এর কারণ ছিল, প্রচুর সংখ্যক অনারব ইসলাম গ্রহণ করছিলেন এবং কুরআনকে একটি গ্রন্থে সংকলিত করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল যেন মুসলিমরা এতে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে এবং কুরআনের বিভিন্ন তিলাওয়াতরীতি (Qirāʾāt) থেকে উদ্ভূত বিভ্রান্তি দূর করা যায়। এ উদ্যোগ থেকেই কুরআনের রচনাশৈলীর বিজ্ঞান علم رسم القرآن)) এর সূচনা হয়, যেখানে কুরআন লেখার মূলনীতি ও নিয়মাবলি স্থাপন করা হয়।
হুযাইফা বিন আল-ইয়ামান رضي الله عنه তখন উসমান رضي الله عنه – এর কাছে আসেন, যখন শাম ও ইরাকের মানুষ আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান জয় করতে যুদ্ধ করছিল। হুযাইফা رضي الله عنه কুরআন তিলাওয়াতে শাম ও ইরাকের জনগণের মধ্যকার পার্থক্য দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন, তাই তিনি উসমান رضي الله عنه – কে বললেন, “হে আমিরুল মু’মিনিন! আপনি এই উম্মতকে রক্ষা করুন, যেন তারা কিতাব (কুরআন) সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ না করে, যেমন ইহুদি ও খ্রিস্টানরা করেছিল।”
তখন উসমান رضي الله عنه হাফসা رضي الله عنها – কে বার্তা পাঠালেন: “আমাদের কাছে কুরআনের পাণ্ডুলিপি পাঠান, যেন আমরা নিখুঁতভাবে একাধিক কপি তৈরি করতে পারি এবং পরে আমরা তা আপনাকে ফিরিয়ে দেব।” হাফসা رضي الله عنها তা উসমানের কাছে পাঠান।
এরপর উসমান رضي الله عنه যয়দ ইবন সাবিত, আবদুল্লাহ ইবন আয-যুবায়ের, সাঈদ ইবন আল-আস ও আবদুর রহমান ইবন হারিস ইবন হিশাম رضي الله عنهم – কে নির্দেশ দেন কুরআনের নিখুঁত কপি তৈরি করতে।
উসমান رضي الله عنه ওই তিনজন কুরাইশীকে বলেছিলেন, “তোমরা যদি যয়দ ইবন সাবিতের সঙ্গে কুরআনের কোনো অংশ নিয়ে মতভেদে পড়, তাহলে কুরাইশদের ভাষাতেই তা লিখো, কেননা কুরআন সেই উপভাষাতেই অবতীর্ণ হয়েছে।” তারা তেমনটাই করেন। এরপর যখন তারা বহু কপি তৈরি করে ফেলেন, উসমান رضي الله عنه মূল পাণ্ডুলিপি হাফসা رضي الله عنها – কে ফিরিয়ে দেন।
উসমান رضي الله عنه প্রতিটি মুসলিম প্রদেশে একটি করে কপি পাঠিয়ে দেন, এবং নির্দেশ দেন যে কুরআনের অন্যান্য সকল পাণ্ডুলিপি, খণ্ডিত হোক বা সম্পূর্ণ, সবকিছু পুড়িয়ে ফেলা হোক। [বুখারী]
বর্তমান মুসহাফে সূরাগুলোর যেসব ক্রম রয়েছে, তা উসমান رضي الله عنه ও যয়দ ইবন থাবিত رضي الله عنه – এর সংকলনের ওপর ভিত্তি করেই নির্ধারিত। যয়দ رضي الله عنه নবী করিম ﷺ – এর যুগে ওহি লিখতেন, এবং জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ সাহাবী লেখকদের প্রতি নির্দেশ দিতেন কোন আয়াত কোথায় সংযুক্ত করতে হবে। যদিও কিছু আলেম বলেন, সরাসরি নির্দেশ সবসময় দিতেন না, তবে সূরাগুলোর যে বিন্যাস আমরা পাই, তা রাসূল ﷺ -এর সংকলন ও তিলাওয়াতের ধরণ অনুসারেই ছিল। সাহাবায়ে কিরাম নিজেরা নতুন কোনো ক্রম তৈরি করেননি।
যখন এই মুসহাফ প্রস্তুত হয়ে গেল, তখন আরও ৭টি কপি তৈরি করা হয় এবং তা পাঠানো হয় মক্কা, মাদিনা, বসরা, শাম, কুফা, ইয়ামান ও বাহরাইন-এ। এরপর মানুষ এই মুসহাফের ভিত্তিতে নিজ নিজ কপি প্রস্তুত করতে থাকে এবং তা অনুযায়ী পাঠদান করতে থাকে।
সাহাবায়ে কিরাম এই উলূমুল কুরআনের শিক্ষা প্রদান অব্যাহত রাখেন, এবং উমাইয়া খেলাফতের সময় দেখা যায় সিনিয়র সাহাবি ও তাবেঈনগণ কুরআন সম্পর্কিত জ্ঞান, যেমন—তাফসীর, কিরাআত, নাসিখ ও মানসুখ আয়াত এবং মুতাশাবিহাতের আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা—প্রচারে অধিকতর ভূমিকা পালন করেন। তবে তখনও এই জ্ঞান প্রাথমিকভাবে মৌখিকভাবে শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রচার করা হতো।
চারজন প্রধান সাহাবি কুরআনের এই জ্ঞানের বিস্তারে বিশেষ অবদানের জন্য বিখ্যাত:
১. আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস
২. আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ
৩. যায়দ ইবন থাবিত
৪. আবু মূসা আল-আশ’আরী
তাঁদের সঙ্গে আলি ইবন আবু তালিব ও উবাই ইবন কা’ব رضي الله عنهم –কেও কুরআনিক শাস্ত্রের প্রথম প্রজন্মের বিশিষ্ট আলেম হিসেবে গণ্য করা হয়।
তাদের শিষ্যদের মধ্যে প্রসিদ্ধদের কিছু হলেন:
আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস رضي الله عنه –এর ছাত্র: মুজাহিদ, আতা, ইকরিমা, সাঈদ ইবন জুবায়ের
ইবন মাসউদ رضي الله عنه –এর ছাত্র: হাসান আল-বসরি, কাতাদা, যায়দ ইবন আসলাম, আবদুর রহমান, মালিক ইবন আনাস।
Footnote:
[1] Qirāʾāt al-Āḥād (قراءات الآحاد) বা একক বর্ণনার কিরাআত—বুঝায় কুরআনের এমন কিছু বিকল্প তিলাওয়াত যেগুলো একজন বা অল্পসংখ্যক বর্ণনাকারীর মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে, ব্যাপক ও ধারাবাহিক বর্ণনার (তাওয়াছুর) মাধ্যমে নয়। এই তিলাওয়াতগুলো প্রচলিত কিরাআত থেকে আলাদা, যেগুলো ব্যাপক সংখ্যক নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছেছে এবং যার ফলে সেগুলো সর্বজনস্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত। [সম্পাদক]
[2] হাদীস কুদসী হলো এমন হাদীস যার অর্থ আল্লাহ্র পক্ষ থেকে, কিন্তু শব্দ বা ভাষা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নিজের। এটি কুরআনের মতো আল্লাহর আল্লাহর সরাসরি কথা নয়, কারণ কুরআনের শব্দ ও অর্থ উভয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে। কিন্তু হাদীস কুদসীর ক্ষেত্রে শুধু অর্থটি আল্লাহ্র পক্ষ থেকে হয়, আর বাক্যগুলো রাসূল ﷺ নিজে ব্যক্ত করেন।
[3] الناسخ والمنسوخ (নাসিখ ও মানসুখ আয়াত) কুরআনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার মাধ্যমে বোঝা যায়— কোনো একটি আয়াতের হুকুম পরবর্তীতে অন্য একটি আয়াত দ্বারা রহিত (অপ্রযোজ্য) হয়ে গেছে কিনা।
No Comment! Be the first one.