সারসংক্ষেপ:
নবী আদম عليه السلام ও নবী নূহ عليه السلام -এর মাঝে দশটি প্রজন্ম ছিল, এবং তারা সকলেই ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী জীবন যাপন করত। এই প্রবন্ধটি একটি সংক্ষিপ্তসার, যেখানে নিচের বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়েছে:
- শিরক কিভাবে পৃথিবীতে প্রবেশ করল?
- কেন পৃথিবীতে প্রথম রাসূল প্রেরিত হয়েছিলেন?
- মূর্তিপূজা কিভাবে আরবে প্রবেশ করল?
- পাথরের উপাসনা কিভাবে আরবে ছড়িয়ে পড়ল?
- আরবদের উপাস্য প্রধান ৩ জন দেবতা কারা ছিল?
- আল্লাহ আমাদেরকে মূর্তিপূজা সম্পর্কে কী শিক্ষা দেন?
বিস্তারিত:
মূর্তিপূজার উদ্ভব
নবী আদম عليه السلام ও নবী নূহ عليه السلام-এর মাঝে দশটি প্রজন্ম ছিল, এবং তারা সকলেই ইসলামের পথ অনুসরণ করত। শিরক প্রথম শুরু হয় নবী নূহ عليه السلام-এর জাতির মাঝে, যখন তারা তাদের মধ্যে পাঁচজন সৎ ব্যক্তির মর্যাদা অতিরিক্তভাবে বাড়িয়ে তোলে। প্রথম যাকে মূর্তি বানিয়ে পূজা করা হয় তার নাম ছিল ‘ওয়াদ্দ’।
ইমাম ইবন কাসির حفظه الله বর্ণনা করেন:
“ওয়াদ্দ ছিল বাবিল নগরীর একজন সৎ ব্যক্তি যাকে তার জাতি ভালোবাসত। সে মারা গেলে, তার কবরের চারপাশে মানুষ জড়ো হয়ে শোক প্রকাশ করত। শয়তান তাদের নিকট এসে বলল, ‘আমি তোমাদের এই ব্যক্তির মৃত্যুতে শোকাহত দেখতে পাচ্ছি; আমি কি তার মত একটি মূর্তি বানিয়ে দিব যেটা তোমরা তোমাদের সমাবেশস্থলে রাখতে পারো, তাকে স্মরণ করার জন্য?’ তারা সম্মত হল। এরপর শয়তান একটি মূর্তি তৈরি করল, এবং তারা সেটি তাদের মিলনস্থলে স্থাপন করল, তার কথা স্মরণ করার জন্য ও ভালো কাজ করার জন্য। এরপর শয়তান বলল, ‘আমি কি তোমাদের প্রতিটি ঘরের জন্য তার একটি মূর্তি বানিয়ে দিতে পারি, যেন সে প্রত্যেকের ঘরে থাকে এবং তোমরা তাকে স্মরণ করতে পার?’ তারা রাজি হয়ে গেল। তাদের সন্তানরাও শিখল ও দেখল তারা যা করছে। তারা তাদের পূর্বপুরুষগণ যেভাবে তাকে স্মরণ করত, সেই পদ্ধতিও শিখে নেয়, যতক্ষণ না তারা তাকে উপাস্য মনে করতে শুরু করে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তারই ইবাদত করতে থাকে এই ধারা চলতে লাগল। সুতরাং, আল্লাহর পরিবর্তে যাকে প্রথম উপাস্য বানানো হয়, সে ছিল ‘ওয়াদ্দ‘—এই নামেই তারা এই মূর্তিকে ডাকে।”
[তাফসীর ইবন কাসির]
ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে একাধিক মূর্তি তৈরি হয়, এবং এই পাঁচজন সৎ ব্যক্তির মূর্তিগুলো সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
নবী নূহ عليه السلام ছিলেন মানবজাতির প্রতি প্রেরিত প্রথম রাসূল, যিনি শিরক নির্মূল এবং যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য উপাস্যের ইবাদত করে তাদের পথনির্দেশ দেয়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল।
নবী মুহাম্মদ ﷺ-এর আগমনের সময় পৃথিবীতে আর কোনো নবী জীবিত ছিলেন না, তবে কিছু শারিয়াহ টিকে ছিল। বিশেষ করে, নবী ইবরাহিম عليه السلام এবং ইসমাইল عليه السلام-এর শারিয়াহ, যার মধ্যে ছিল হজ্বের আচার-অনুষ্ঠান, কা’বাকে তাওয়াফ, আল্লাহকে আহ্বান করা ইত্যাদি। কিন্তু এসব ধীরে ধীরে বিকৃত হয়ে যায়।
আসলে, আরবদের মধ্যে মূর্তিপূজা ছিল একেবারেই নতুন ধারণা। এমনকি মূর্তির জন্য ব্যবহৃত আরবি ‘Sanam’ শব্দটিও স্পষ্টত আরামাইক শব্দ ‘Selem’ থেকে উদ্ভূত।
সবকিছু শুরু হয় বনি খুজাআহ গোত্রের একজন ব্যক্তি আমর ইবন লুহাই-এর মাধ্যমে। তিনি সিরিয়ায় ভ্রমণ করেন এবং সেখানে হুবাল নামক একটি বিশাল মূর্তিকে ঘিরে জাঁকজমক অনুষ্ঠান দেখেন। আমালিকা (Amalkites) জাতি ছিল ক্ষমতাবান ও সফল জাতি, তারা এই মূর্তিকে পূজা করত এবং তাদের সাফল্য এই মুর্তির প্রতি উৎসর্গ করত। নিজ হীনম্মন্যতা থেকে এবং নিজের গোত্রে এই ‘গৌরব ও অগ্রগতি’ আনার লোভে, সে ধরে নেয় যে এরা নিশ্চয়ই সঠিক পথে আছে—কারণ তারা এত শক্তিশালী। তাই তিনি হুবাল মূর্তিটির জন্য প্রচুর অর্থ প্রদান করে সেটিকে মক্কার হারামে নিয়ে আসেন।
আমর ইবন লুহাই ছিলেন একজন সম্মানিত ব্যক্তি, তার গোত্রের নেতা, যাকে সবাই ভালোবাসত। তাই যখন সে একটি ‘নতুন ধারণা’ নিয়ে আসলো লোকেরা সহজেই তাকে অনুসরণ করে সেই মূর্তিকে পূজা করতে শুরু করে। আমর কুরাইশ গোত্রের প্রতিষ্ঠাতা ফিহর-এর সমসাময়িক ছিলেন। এ থেকে অনুমান করা যায়, প্রায় পাঁচ শতাব্দী ধরে এই মূর্তিপূজা আরব ভূমিতে শিকড় গেড়ে বসে।
ইমাম ইবন হজর رحمه الله বর্ণনা করেছেন, আমর ইবন লুহাই শুধু হুবাল নয়, বরং ওয়াদ্দ, সুয়া’, ইয়াগুছ, ইয়াউক, এবং নাসর নামক মূর্তিগুলোরও প্রচলন করেন। বলা হয়, এক জিন তাকে জানায় ইশ্বরের প্রতিচ্ছবি জেদ্দার একটি নির্দিষ্ট স্থানে আছে এবং সেগুলো এনে পূজা করা উচিত।
[ফাতহুল বারি]
তিনি হজ্বের তলবিয়াও পরিবর্তন করে ফেলেন।
মূল তলবিয়া ছিল:
لبيك اللهم لبيك، لبيك لا شريك لك لبيك
লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক! লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক!
(আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি হাজির! আপনার কোনো শরীক নেই।)
আমর এটি পরিবর্তন করে বললেন:
لبيك اللهم لبيك، لبيك لا شريك لك إلا شريكاً هو لك، تملكه وما ملك
লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক! লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা ইল্লা শারীকা হুয়া লাক, তামলিকুহু ওয়া মা মালাক
(আমি হাজির, হে আল্লাহ! আপনার কোনো শরীক নেই, শুধুমাত্র এমন শরীক ছাড়া যে আপনার আওতাধীন, আপনি তাকে ও যা কিছু তার অধীনে আছে তা নিয়ন্ত্রণ করেন।)
নবী ইসমাইল عليه السلام -এর পর থেকে আমর পর্যন্ত শত বছর পেরিয়ে যায়, ততদিন পর্যন্ত আরবদের জন্য আর কোনো রাসূল পাঠানো হয়নি। অজ্ঞতা ছড়িয়ে পড়ে, ফলে মানুষ ইব্রাহিম আলাইহিসসালাম -এর শারিয়াহ ভুলে যায়। এটা তখনই ঘটে যখন কেউ দীর্ঘ সময় ধরে কোনো বিষয়ের সংস্পর্শে না থাকে—তখন সেটি ধীরে ধীরে ভুলে যায়, মুছে যায়, বিলীন হয়ে যায়। মানুষ যখন তাদের শরিয়াহর পবিত্রতা ও দৃঢ়তার শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞ হয়ে পড়ে, তখন তারা সহজেই ‘সবচেয়ে শক্তিশালী জাতির’ বাহ্যিক চাকচিক্যময় ধর্মে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং নিজেদের প্রকৃত অতীতকে প্রত্যাখ্যান করে। তারা যখন শিরকের দরজা খুলে দিল, তখন তা একটার পর একটা দিক থেকে বিদআত এবং কাফেরদের খারাপ কর্মপন্থার গ্রহণযোগ্যতার পথ খুলে দেয়। পরবর্তীতে, মূর্তিপূজায় লিপ্ত আরবরা সাহস করে দাবি করে বসে যে তারা নবী ইবরাহিম عليه السلام-এর অনুসরণকারী, অথচ বাস্তবে তারা নিজেদের প্রবৃত্তি এবং পূর্বপুরুষদের বিকৃত ধর্মকে ধর্মীয় মুখোশের আড়ালে অনুসরণ করছিল।
এই মূর্তিগুলো পরে হজ্বে আগতদের মাঝে বিতরণ করা হতো। ইবন আব্বাস رضي الله عنه বলেন,
“নূহ عليه السلام -এর কওমের যেসব মূর্তি ছিল, তা পরে আরবদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। ওয়াদ্দ ছিল দাউমাতুল জান্দালের (Dawmat Al-Jandal) কালব গোত্রের উপাস্য। সুয়া’ ছিল হুযায়লদের (Hudhayl) উপাস্য। ইয়াগুছ মূর্তিটি মুরাদ গোত্রের উপাস্য হয়ে ওঠে, এরপর সাবা অঞ্চলের আল-জুরুফ এলাকায় বানু গুতাইফ (Bani Ghutayf) গোত্র এটিকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করে। ইয়াউক ছিল হামদান গোত্রের উপাস্য। নাসর ছিল হিময়ার গোত্রের ধু কালা পরিবারে উপাস্য হিসেবে পূজিত। এই সব মূর্তিই ছিল নূহ عليه السلام -এর কালের নেককার লোকদের নামে নামকরণ করা।”
[বুখারি]
আরব ভূখণ্ডে পাথরের উপাসনা কীভাবে ছড়িয়ে পড়ে?
ইমাম ইবন ইসহাক رحمه الله উল্লেখ করেছেন, যখন নবী ইসমাঈল عليه السلام -এর বংশধরেরা মক্কা থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপন করেন, তখন তারা কা’বার স্মৃতি হিসেবে পবিত্র সীমারেখা থেকে একটি করে পাথর সঙ্গে নিয়ে যান। তারা সেই পাথরগুলো নিজেদের নতুন বসতিতে উপযুক্ত স্থানে স্থাপন করতেন এবং কা’বার মতোই তার চারপাশে তাওয়াফ করতেন ও তার প্রতি ভক্তিভরে সম্মান করতেন। ধীরে ধীরে, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম শুধু ঐ নির্দিষ্ট পাথরগুলোই নয়, বরং যেকোনো অনুরূপ বা বিশেষ রকমের পাথরকেও উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করে পূজা করতে শুরু করে।
আবু রাজা আল-উতারিদী বর্ণনা করেন:
“আমরা পাথর পূজা করতাম। যদি আগের চেয়ে ভালো কোনো পাথর পেতাম, তাহলে পুরনোটা ফেলে দিয়ে নতুনটিকে গ্রহণ করতাম। আর যদি কোনো পাথর না পেতাম, তাহলে কিছু মাটি জড়ো করতাম, তারপর একটি ছাগী এনে তার দুধ মাটির ওপর দোহন করতাম, এবং সেই মাটির চারপাশে তাওয়াফ করতাম।” [বুখারি]
এইভাবে সমাজে মূর্তিপূজা ছড়িয়ে পড়ে, এমনকি প্রতিটি গোত্রেরই নিজস্ব মূর্তি ছিল। শুধু গোত্র নয়, অনেক সময় পরিবারের মধ্যেও একটি নির্দিষ্ট মূর্তি থাকত যাকে তারা শ্রদ্ধা করত ও উপাসনা করত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্মের সময় কা’বার অভ্যন্তরে প্রায় ৩৬০টি মূর্তি রাখা ছিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল হুবাল, যেটিকে আমর ইবন লুহাই কা’বায় এনেছিলেন।
আরবদের মূর্তিপূজা
নবী নূহ عليه السلام -এর কওমের মতোই, আরবদের বিশ্বাসেও ধীরে ধীরে বিকৃতি ছড়িয়ে পড়ে:
অধিকাংশ মূর্তি বা দেবতাদের নাম ছিল আল্লাহর গুণাবলির অনুকরণে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল আল-লাত, আল-উজ্জা ও মানাত। এদেরকে তারা আল্লাহর কন্যা মনে করত। আল-লাত নামটি তারা “আল্লাহ”-এর স্ত্রীলিঙ্গ রূপ হিসেবে তৈরি করে, আর আল-উজ্জা এসেছে “আল-আযীয” থেকে। এই তিনটি মূল দেবতার উৎপত্তির পেছনে ছিল তিনটি উৎস—মানব, উদ্ভিদ ও পাথর।
আরবরা মুশরিকদের মতো এই ধারণা গ্রহণ করেছিল যে, এই দেবীরা এবং ফেরেশতারাও আল্লাহ ও তাদের মাঝে ‘শাফায়েতকারী’ বা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে।
আল-লাত ছিল এক ব্যক্তি, যিনি জাহিলিয়ার যুগে হজ্বে আগতদের জন্য সাওইক [Sawiq] (এক ধরনের জবের মিশ্রণ) পানির সাথে মিশিয়ে প্রস্তুত করতেন। তার মৃত্যুর পর মানুষ তার কবরের পাশে অবস্থান করতে থাকে এবং পরে তাকে উপাস্য বানিয়ে ফেলে। তাইফবাসী, তথা সাকীফ গোত্র এবং তাদের মিত্ররা আল-লাতের পূজায় লিপ্ত ছিল।
নাবাতীয় (Nabatean) লিপিতে আল-লাত সম্পর্কে একাধিক উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে তাকে বলা হয়েছে: “দেবীদের জননী”।
আল-উজ্জা মূলত ছিল কিছু ঝোপঝাড় বা গাছের একটি গুচ্ছ, যার উপরে মূর্তিপূজকেরা একটি স্মৃতিস্তম্ভ ও পর্দা ঝুলিয়ে রাখত। তারা বিশ্বাস করত, গ্রহ ‘শুক্র’ (Venus) এই দেবীর প্রতীক এবং এর আরবি রূপ ছিল ‘আল-উজ্জা’ যার অর্থ “সবচেয়ে শক্তিশালী”। তাদের ধারণায়, এই দেবী ঐ গাছগুলোতেই বসবাস করত, যা মক্কা ও তাইফের মাঝামাঝি ‘নাখলা’ নামক স্থানে অবস্থিত ছিল। কুরাইশ গোত্র আল-উজ্জাকে অত্যন্ত সম্মান করত।
যেমন আজ ‘আবদুল্লাহ’ নামটি প্রচলিত, তেমনি জাহিলিয়ার যুগে ‘আবদুল-উজ্জা’ নামটিও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত।
মানাত ছিল একটি কালো পাথরের তৈরি মূর্তি, যেটি ছিল ভাগ্যের দেবীর প্রতীক। এটি কুদায়দের কাছে ‘মুশাল্লাল’ (Mushallal) নামক স্থানে স্থাপিত ছিল, যা মক্কা ও মদিনার মাঝামাঝি এলাকায় পড়ে। খুযা’আ, আওস ও খাজরাজ গোত্র মানাতকে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা করত।
মক্কার কা’বা ব্যতীতও আরবরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে উপাসনালয় নির্মাণ করেছিল। তারা তাদের মূর্তিগুলোর জন্য কা’বার অনুকরণে ঘর তৈরি করত।
আল-লাতের মূর্তি তায়েফবাসীর উপাস্য ছিল। আল-উজ্জার মূর্তি নাখলায় পূজিত হতো। মানাতের মূর্তি লাল সাগরের নিকটবর্তী কুদায়দ এলাকায় পূজিত হতো।
‘যুল খালাসাহ’ নামক মূর্তি তাবালাহ অঞ্চলে উপাসনা করা হতো। এটি ছিল তথাকথিত “দক্ষিণ কা’বা”, আর মক্কার কা’বাকে বলা হতো “উত্তর কা’বা”।
মক্কার হুনাফা
একই সময়ে মক্কায়, নবী ইবরাহিম عليه السلام -এর শিক্ষার কিছু অংশ এখনো বিদ্যমান ছিল। কয়েকজন ব্যক্তি মূর্তিপূজা থেকে বিরত থাকতেন। এদেরকেই বলা হতো হানীফ (বহুবচনে: হুনাফা)—যার অর্থ “ফিরে যাওয়া”। তাদের হুনাফা বলা হতো কারণ তারা শিরক ও মূর্তিপূজা থেকে ফিরে এসে আল্লাহর দিকে মুখ ফিরিয়েছিল।
1. ওয়ারাকা ইবন নওফাল ইবন আসাদ: তিনি ছিলেন খাদিজাহ বিনতে খুয়াইলিদ ইবন আসাদ رضي الله عنها – এর চাচাত ভাই। ওয়ারাকা খাদিজাহর চেয়ে প্রায় ৪০ বছর বড় ছিলেন। তিনি এক পর্যায়ে খ্রিস্টধর্ম ও ইহুদি ধর্মের একটি সংমিশ্রণ গ্রহণ করেন, যেখানে ঈসা عليه السلام -কে আল্লাহর বান্দা হিসেবে মানা হতো, কিন্তু তাঁকে খোদা বলা হতো না। তিনি পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের একজন পণ্ডিত ছিলেন এবং জানতেন যে একজন নবীর আবির্ভাব আসন্ন। যখন নবী মুহাম্মদ ﷺ তাঁকে তাঁর ঘটনা শুনালেন, তখন তিনি তাৎক্ষণিকভাবে জিবরীল عليه السلام- কে চিনে ফেললেন, যিনি পূর্বে নবী মূসা عليه السلام -এর কাছেও এসেছিলেন। মৃত্যুর আগে ওয়ারাকা নবী মুহাম্মদ ﷺ -কে আল্লাহর রাসূল হিসেবে নিশ্চিত করেন।
2. উবাইদুল্লাহ ইবন জাহশ: তিনি ছিলেন রাসূল ﷺ -এর এক খালাতো ভাই এবং জয়নব বিনতে জাহশ رضي الله عنه -এর ভাই। তিনি প্রথমে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, এরপর ইসলাম কবুল করেন। তিনি তার স্ত্রীসহ আবিসিনিয়ায় (হাবশা) হিজরত করেন। কিন্তু সেখানে তিনি মদের আসক্ত হয়ে পড়েন এবং পরে আবারও খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে মুরতাদ হয়ে যান। তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী রামলাহ উম্মে হাবীবাহ নবী ﷺ -এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
৩. উসমান ইবনুল হুয়ারিস: তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর জন্মের পূর্বে মক্কা ত্যাগ করেন। জানা যায়, তিনি রোমে গিয়েছিলেন এবং ত্রিত্ববাদী খ্রিষ্টধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরে তিনি ফিরে এসে তার জাতিকে এই নতুন ধর্মের অনুসরণে আহ্বান জানানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু তার গোত্র তাকে উপহাস করে ও বর্জন করে। রোমানরাও তাকে ত্যাগ করে, এবং তিনি একজন খ্রিষ্টান হিসেবে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে মৃত্যুবরণ করেন।
৪. যায়দ ইবনু আমর ইবনু নুফায়েল: তিনি ছিলেন উমর ইবনুল খাত্তাব ইবনু নুফায়েলের চাচাতো ভাই। তালিকাভুক্ত হুনাফাদের মধ্যে সম্ভবত তিনিই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি একেশ্বরবাদে সবচেয়ে দৃঢ় ছিলেন। তিনি খ্রিষ্টধর্ম কিংবা ইহুদি ধর্ম কোনোটাই গ্রহণ করেননি। তিনি ইবরাহিম عليه السلام -এর সত্য ধর্ম অনুসন্ধানে ফিলিস্তিনে ভ্রমণ করেন। সেখানে তিনি প্রথমে একজন ইহুদি আলেম ও পরে একজন খ্রিষ্টান আলেমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু তিনি বুঝে যান, এটি ইবরাহিম عليه السلام – এর পথ নয়। অতঃপর তিনি সএ জায়গা ত্যাগ করে উভয় হাত তুলে বলেন: “হে আল্লাহ! আমি আপনাকে সাক্ষী রাখছি যে, আমি ইবরাহিমের ধর্মে আছি।” [বুখারি]
তিনি প্রকাশ্যে কুরাইশদের মূর্তিপূজা ও মূর্তির নামে কুরবানির বিরুদ্ধাচরণ করতেন। নবুয়তের পূর্বে রাসূল ﷺ মক্কায় যায়দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। একবার রাসূলﷺ -এর সামনে একটি খাবার পেশ করা হলে তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। একই খাবার যায়দের কাছেও পেশ করা হলে তিনি বলেন, “আমি এমন কিছু খাই না যা তোমরা তোমাদের পাথরের মূর্তির নামে জবাই করো। আমি কেবলমাত্র সেই জবাইকৃত বস্তু খাই, যার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়েছে।”
যায়দ ইবনু আমর কুরাইশদের পশু জবাইয়ের পদ্ধতির কড়া সমালোচনা করতেন এবং বলতেন, “আল্লাহ মেষ সৃষ্টি করেছেন, আকাশ থেকে তার জন্য পানি পাঠিয়েছেন, আর মাটিতে তার জন্য ঘাস উৎপন্ন করেছেন, অথচ তোমরা তা আল্লাহর নাম ব্যতীত অন্যের নামে জবাই করো!” [বুখারি]
তিনি কন্যাসন্তানদের জীবন্ত কবর দেওয়ার জাহেলী প্রথার ঘোর বিরোধিতা করতেন। কুরাইশরা যেসব কন্যাশিশুকে হত্যা করতে চাইতো, তিনি তাদের দত্তক নিতেন এবং নিজের মতো লালন-পালন করতেন। তিনি সেই পিতাকে বলতেন, “তোমার মেয়েকে হত্যা করো না, আমি তার ভরণপোষণ করবো।” তিনি মেয়েটিকে লালন-পালন করতেন এবং যখন সে বড় হতো, তখন তার পিতাকে বলতেন, “তুমি যদি চাও, আমি তাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেব, আর যদি না চাও, আমি তার ভরণপোষণ চালিয়ে যাব।” [বুখারি]
বলা হয়ে থাকে, রাসূল ﷺ ইসলাম প্রচার শুরু করার পাঁচ বছর আগে তিনি ইন্তিকাল করেন। রাসূল ﷺ বলেন, “সে কিয়ামতের দিন একা একটি উম্মত হিসেবে পুনরুত্থিত হবে।” তার ছেলে সাঈদ ইবন যায়দ রাদি. পরবর্তীতে একজন বিশিষ্ট সাহাবী হন এবং জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশ সাহাবীর একজন ছিলেন।
৫. কুস ইবনু সাঈদা: তিনি ছিলেন বানু ইয়াদ গোত্রের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, যিনি কুরাইশদের মূর্তিপূজা থেকে সতর্ক করতেন এবং এ বিষয়ে কবিতাও রচনা করেছিলেন।
একেশ্বরবাদে প্রত্যাবর্তন
৮ হিজরিতে রাসূলুল্লাহ ﷺ মক্কা বিজয় করে যখন সেখানে প্রবেশ করেন, তখন তিনি কা‘বা ঘর ও তার চারপাশে স্থাপিত ৩৬০টি মূর্তি অপসারণ করেন। তিনি তার সাহাবাদের আরবের বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করেন, যেখানে মাজার নির্মিত হয়েছিল এবং মূর্তি পূজা করা হতো—সেসব ধ্বংস করার জন্য। রাসূলুল্লাহ ﷺ যেসব সাহাবাকে পাঠিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন:
- মুগীরা ইবনু শু‘বা ও আবু সুফিয়ান সাখর বিন হারব—আল-লাত মূর্তি ধ্বংসের জন্য।
- খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ—আল-উজ্জা মূর্তি ধ্বংসের জন্য।
- আলী ইবনু আবি তালিব ও সা‘দ ইবন যায়দ আল-আশহালী—মানাত মূর্তি ধ্বংসের জন্য।
- আমর ইবনুল ‘আস—সুয়া’ মূর্তি ধ্বংসের জন্য।
- জারীর ইবন আবদুল্লাহ আল-বাদজালী—যুল খালাসা মূর্তি ধ্বংসের জন্য।
- আলী ইবনু আবি তালিব—ফালস মূর্তি ধ্বংসের জন্য।
আল্লাহ আমাদের শিক্ষা দেন:
وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ ٱللَّهُ ۚ قُلْ أَفَرَءَيْتُم مَّا تَدْعُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ إِنْ أَرَادَنِىَ ٱللَّهُ بِضُرٍّ هَلْ هُنَّ كَـٰشِفَـٰتُ ضُرِّهِۦٓ أَوْ أَرَادَنِى بِرَحْمَةٍ هَلْ هُنَّ مُمْسِكَـٰتُ رَحْمَتِهِۦ ۚ قُلْ حَسْبِىَ ٱللَّهُ ۖ عَلَيْهِ يَتَوَكَّلُ ٱلْمُتَوَكِّلُونَ
“তুমি যদি তাদের জিজ্ঞাসা করো (হে নবী), ‘কে আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছে?’—তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ।’ বলো, ‘তবে তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদের ডাকো, তাদের কথা চিন্তা করে দেখো তো: যদি আল্লাহ আমাকে কোনো কষ্ট দিতে চান, তবে কি তারা সে কষ্ট দূর করতে পারবে? আর যদি তিনি আমাকে কোনো রহমত দিতে চান, তবে কি তারা তা প্রতিহত করতে পারবে?’ বলো, ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। ভরসাকারীদের উচিৎ কেবল তাঁরই উপর ভরসা করা।”
[সূরা যুমার, ৩৮]
وَيَعْبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَـٰٓؤُلَآءِ شُفَعَـٰٓؤُنَا عِندَ ٱللَّهِ ۚ قُلْ أَتُنَبِّـُٔونَ ٱللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِى ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَلَا فِى ٱلْأَرْضِ ۚ سُبْحَـٰنَهُۥ وَتَعَـٰلَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ “আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর ইবাদত করছে, যা তাদের ক্ষতি করতে পারে না এবং উপকারও করতে পারে না। আর তারা বলে, ‘এরা আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী’। বল, ‘তোমরা কি আল্লাহকে আসমানসমূহ ও যমীনে থাকা এমন বিষয়ে সংবাদ দিচ্ছ যা তিনি অবগত নন’? তিনি পবিত্র মহান এবং তারা যা শরীক করে, তা থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে।” [সূরা ইউনুস, ১৮]
وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّن يَدْعُوا۟ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَن لَّا يَسْتَجِيبُ لَهُۥٓ إِلَىٰ يَوْمِ ٱلْقِيَـٰمَةِ وَهُمْ عَن دُعَآئِهِمْ غَـٰفِلُونَ
“তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে, যে আল্লাহর পরিবর্তে এমন কাউকে ডাকে, যে কিয়ামত দিবস পর্যন্তও তার ডাকে সাড়া দেবে না? আর তারা তাদের আহবান সম্পর্কে উদাসীন।”
[সূরা আহকাফ, ৫]
No Comment! Be the first one.