জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের আমল
মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَٱلْفَجْرِ
وَلَيَالٍ عَشْرٍۢ
وَٱلشَّفْعِ وَٱلْوَتْر
শপথ ফজরের
শপথ দশ রাতের,
শপথ জোড় ও বেজোড়ের। [সূরা ফজর: ১-৩]
এখানে আল্লাহ তা’আলা দশ রাতের কসম করেছেন, এ ব্যাপারে মুফাসসিরগণের মতপার্থক্য রয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস رضي الله عنه -এর মতে দশরাত্র বলতে জিলহজ মাসের প্রথম দশরাতকে বুঝানো হয়েছে। রাসূল ﷺ বলেন,
عن جابر ، عن النبي – صلى الله عليه وسلم – قال إن العشر عشر الأضحى ، والوتر يوم عرفة ، والشفع يوم النحر
“দশম দিন হলো ঈদুল-আজহার দিন, বিজোড় হলো আরাফার দিন, আর জোড় হলো কুরবানির দিন।” [আহমাদ]
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
عن جابر رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال ‘أفضل أيام الدنيا العشر يعني عشر ذي الحجة’
“দুনিয়ার দিনসমূহের মধ্যে জিলহজের প্রথম দশদিন সর্বোত্তম দিন।” [সহিহুল জামে’- ১১৩৩]
জিলহজ মাসের আমলগুলোকে সাধারণত দুইভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, আম বা সাধারণ ইবাদত। অর্থাৎ, জিলহজ মাসের প্রথম দশদিন বছরের অন্যান্য দিনের ন্যায় সকল নেক আমল করা, যেমন- সালাত, সিয়াম, দান-সদকা, তাসবিহ, তাহলিল, দুরুদ, ও পাপ থেকে তাওবা ইত্যাদি।
দ্বিতীয়ত, খাস বা বিশেষ ইবাদত। জিলহজ মাসের দশদিনের জন্য বিশেষ কিছু আমল কুরআন-হাদিসে উল্লেখিত হয়েছে। নিচে এমন কিছু আমল বর্ণনা করা হলো—
১) চুল ও নখ কর্তন না করা: জিলহজ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানি পর্যন্ত চুল ও নখ কর্তন না করা। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
إذا رأيتم هلال ذي الحجة، وأراد أحدكم أن يضحي، فليمسك عن شعره وأظفاره وفي رواية: حتى يضحي.
“তোমাদের মধ্যে যারা কুরবানি দেওয়ার ইচ্ছা রাখে, তারা যেন জিলহজ্জ মাসের নতুন চাঁদ ওঠার পর থেকে কুরবানি করার পূর্ব পর্যন্ত তাদের চুল ও নখ না কাটে। অন্য বর্ণনায় আছে ‘কুরবানির পশু যবেহ করার পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থায় থাকবে।।” [সহিহ মুসলিম: ১৯৭৭]
২) তাকবির পাঠ করা: তাকবির তথা আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করা এই দিনগুলোর অন্যতম আমল। তবে তাকবির পাঠের সময়সীমা দুই ধরনের হতে পারে। প্রথমত, আম বা ব্যাপক তাকবির। জিলহজ মাসের শুরু থেকে ১০/১৩ তারিখ পর্যন্ত পাঠ করা। যেমন- আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَٱذْكُرُوا۟ ٱللَّهَ فِىٓ أَيَّامٍۢ مَّعْدُودَٰتٍۢ
“আর তোমরা গণনাকৃত দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ করবে।” [সূরা বাকারা- ২০৩]
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস رضي الله عنه বলেন, “এখানে জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনকে বুঝানো হয়েছে। এজন্য ইবনে উমর ও আবু হুরায়রা رضي الله عنهما জিলহজ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে তাকবির বলতে বলতে বাজারে যেতেন এবং তাদের তাকবিরের সঙ্গে অন্যরাও তাকবির বলতেন। মুহাম্মদ ইবনে আলি رحمه الله নফল সালাতের পরও তাকবির বলতেন। [বুখারি- ১২৮৪]
আমাদের মুসলিম হিসেবে কোনোরকম সংকোচ ও হীনমন্যতা অনুভব না করে এ মাসের শুরু থেকে তাকবির পাঠ করা। দ্বিতীয়ত, খাস বা নির্দিষ্ট দিনে তাকবির পাঠ করা। জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজর হতে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ সালাতের পর ১ বার তাকবির পাঠ করা।
اللّٰهُ أَكْبَرُ ❁ اللّٰهُ أَكْبَرُ ❁ لَآ إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ وَاللّٰهُ أَكْبَرُ ❁ اللّٰهُ أَكْبَرُ ❁ وَلِلّٰهِ الْحَمْدِ
আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ও লিল্লাহিল হামদ।
৩) জিকির করা: বেশি বেশি জিকির করা, তথা তাসবিহ, তাহমিদ, তাহলিল ও তাকবির পাঠ করা। মহান আল্লাহ বলেন,
لِّيَشْهَدُوا۟ مَنَـٰفِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا۟ ٱسْمَ ٱللَّهِ فِىٓ أَيَّامٍۢ مَّعْلُومَـٰتٍ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّنۢ بَهِيمَةِ ٱلْأَنْعَـٰمِ ۖ فَكُلُوا۟ مِنْهَا وَأَطْعِمُوا۟ ٱلْبَآئِسَ ٱلْفَقِير
যাতে তারা তাদের কল্যানময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিজিক হিসিবে দান করেছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে। [সূরা হজ: ২৮]
অধিকাংশ মুফাসসিরগণদের মতে এ আয়াতে নির্দিষ্ট দিন বলতে জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনকে বুঝানো হয়েছে। এ সময় আল্লাহর বান্দাগণ বেশি বেশি করে তাঁর জিকির করেন। অর্থাৎ, আল্লাহর প্রশংসা, তাঁর পবিত্রতা, নেয়ামতের শুকরিয়া এবং কুরবানির পশু জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম ও তাকবির উচ্চারণ করেন।
৪) সিয়াম পালন করা: জিলহজ মাসের প্রথম দশদিনের বিশেষ আমল হলো সিয়াম পালন করা। নবি ﷺ -এর কোনো একজন স্ত্রী বর্ণনা করেছেন,
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يصوم تسع ذي الحجة، ويوم عاشوراء، وثلاثة أيام من كل شهر أول اثنين من الشهر والخميس
রাসূলুল্লাহ ﷺ জিলহজ মাসের প্রথম নয়দিন, আশুরার দিন, প্রত্যেক মাসের তিনদিন এবং মাসের দুই সোম ও বৃহস্পতিবার সিয়াম পালন করতেন। [নাসাঈ’- ২৪১৭]
জিলহজ মাসের প্রথম দিন থেকে ৯ম দিন সিয়াম পালন করা যা রাসূল ﷺ করেছেন, এটা না পারলে কমপক্ষে আরাফার দিন সিয়াম পালন করা।
আরাফার দিন সিয়াম: হজ পালনকারী ছাড়া অন্যদের জন্য আরাফার দিন সিয়াম রাখা। আবু কাতাদাহ رضي الله عنه হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ -কে আরাফার দিন সিয়াম রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন,
إِنِّي أحْتَسِبُ على اللهِ أنْ يُكَفِّرَ السنَةَ التي قَبلَهُ، والسنَةَ التي بَعدَهُ
“আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী , এই রোজা পূর্ববর্তী ও পরবর্তি এক বছরের গুনাহের কাফফারা হবে।” [মুসলিম- ১১৬৩]
একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আরাফার সিয়াম ৯ই জিলহজ তারিখে পালন করতে হয়। কিন্তু সেটা সৌদি আরব নাকি বাংলাদেশের তা নিয়ে ইসলামি স্কলারদের মতভেদ রয়েছে। অধিকাংশের মতে ভূখন্ড আলাদা হলে তাদের নিজ নিজ দেশের ৯ই জিলহজ তারিখে আরাফার সিয়াম পালন করবেন। তাদের এই মতামতের পক্ষে কুরআন-সুন্নাহর বিশুদ্ধ দলিল রয়েছে। আরেক দল আলেমের মতে যেহেতু একদিন, আর হাজিরা সেদিন আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হন এবং কিয়ামতও একই দিনে হবে, তাই সৌদির সঙ্গে মিল রেখে আরাফার সিয়াম পালন করতে হবে। তাদের এ মতামতের পক্ষেও দলিল রয়েছে। তবে আমরা বিতর্কে না গিয়ে ৮ ও ৯ তারিখ, দুইদিন রোজা রাখতে পারি। এ ব্যাপারেও বিশুদ্ধ দলিল রয়েছে। এবছর ২০২৫ -এ বাংলাদেশে ৫ ও ৬ই জুন সিয়াম পালন করতে পারি ইনশা-আল্লাহ।
৫) হজ পালন করা: সামর্থবান সকল মুসলিমদের উপর হজ ফরজ। যেমন: আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلْبَيْتِ مَنِ ٱسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًۭا ۚ وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ ٱللَّهَ غَنِىٌّ عَنِ ٱلْعَـٰلَمِينَ
“আর মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে ঐ ঘরের হজ্ব করা তার জন্য অবশ্য কর্তব্য। আর যে কেউ কুফরী করল সে জেনে রাখুক, নিশ্চয় আল্লাহ সৃষ্টিজগতের মুখাপেক্ষী নন।”
হজ পালনের জন্য প্রস্তুতিমূলক কয়েকটি মাস থাকলেও একমাত্র জিলহজ মাসেই হজের কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
عن النبي ﷺ أنه قال: لا ينبغي لأحد أن يحرم بالحج إلا في أشهر الحج
“হজের মাস ছাড়া কারো জন্য হজের ইহরাম বাঁধা উচিত নয়। কারণ হজের মাসগুলোতে ইহরাম বাঁধা হজের সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত।”
৬) কুরবানি করা: জিলহজ মাসের প্রথম দশকের শেষ দিন হলো ইয়াওমুন নাহার বা কুরবানির দিন। এই দিনের বিশেষ মর্যাদা ও গুরুত্ব রয়েছে। নবি ﷺ বলেছেন,
إن أعظم الأيام عند الله تبارك وتعالى: يوم النحر ثم يوم القر
“অবশ্যই কুরবানির দিন আল্লাহর নিকট সবচেয়ে মহান দিন। অতঃপর ‘ক্বার’ এর দিন। সাওর বলেন, ক্বার হলো- কুরবানির দ্বিতীয় দিন।” [আবু দাউদ]
সামর্থবান প্রত্যেক মুসলিম এ দিন কুরবানি করে আল্লাহর আদেশ পালন করে থাকেন। কুরবানির নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তা’আলা বলেন,
فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنْحَرْ
“তুমি তোমার রবের জন্য সালাত আদায় করো ও কুরবানি করো।” [সূরা কাউসার- ০২]
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
من وجد سعة ولم يضح، فلا يقربن مصلانا
‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে না আসে।” [ইবনে মাজাহ- ৩১২৩]
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন,
قُلْ إِنَّ صَلَاتِى وَنُسُكِى وَمَحْيَاىَ وَمَمَاتِى لِلَّهِ رَبِّ ٱلْعَـٰلَمِينَ
“বল, ‘নিশ্চয় আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু আল্লাহর জন্য, যিনি সকল সৃষ্টির রব’।”
[সূরা আন’আম- ১৬২]
৭) ঈদের সালাত আদায় করা: এই দশ দিনের অন্যতম আমল হলো ঈদুল-আজহার সালাত আদায় করা। আবু সাঈদ খুদরি رضي الله عنه হতে বর্ণিত,
রাসূল ﷺ ঈদুল-ফিতর ও ঈদুল-আজহার দিন ঈদগাহে যেতেন এবং প্রথমে সালাত আদায় করতেন। আর সালাত শেষে তিনি লোকদের দিকে মুখ করে দাঁড়াতেন আর মুসল্লিরা কাতারে বসে থাকতেন। তিনি তাদের নসিহত, উপদেশ ও আদেশ-নির্দেশ প্রদান করতেন, যদি তিনি কোনো সৈন্যদল পাঠানোর ইচ্ছা করতেন তবে তাদের আলাদা করে নিতেন। অথবা যদি কোনো বিষয়ে নির্দেশ জারি করার ইচ্ছা করতেন তবে তা জারি করতেন। অতঃপর তিনি ফিরে যেতেন।
উল্লেখ্য যে, রাসূল ﷺ -এর যুগে মহিলারাও ঈদগাহে সালাত আদায় করতে যেতেন, এমনকি ঋতুবর্তী মহিলারাও , যদিও তারা সালাত আদায় করতেন না শুধু খুতবা শ্রবণ করতেন। এখনও সম্ভব হলে পর্দার সহিত মহিলারা ঈদগাহে যাবেন ও সালাত আদায় করবেন।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ঈদকে ঈদ বলা হয় দুটি কারণে এক. عيد বা عود থেকে এলে এর অর্থ দাঁড়ায় ঘুরে আসা অর্থাৎ বার বার ফিরে আসার কারণে একে ঈদ বলা হয়। দুই. ঈদ এর পারিভাষিক অর্থ ধরা যায় আনন্দ বা খুশি। এ ব্যাপারে সহিহ বুখারি ও মুসলিমে আয়েশা رضي الله عنه হতে বর্ণিত, সেসময় আনসারদের দুইজন বালিকা গান ও কবিতা আবৃত্তি করছিল এবং দফ বাজাচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ ﷺ পাশে চাদর মুড়ে রেখেছিলেন। এ অবস্থায় আবু বকর رضي الله عنه বালিকা দুটিকে ধমক দিলেন। তখন রাসূল ﷺ চাদর থেকে মুখ বের করে বললেন, “হে আবু বকর, ওদেরকে ছেড়ে দাও, এটা ঈদের দিন।” [বুখারি ও মুসলিম]
অন্য হাদিসে এসেছে, “প্রত্যেক গোত্রের জন্য খুশির দিন আছে আর আমাদের খুশির দিন হলো ঈদুল-ফিতর ও ঈদুল-আজহা।”
এজন্য ঈদকে সেলিব্রেট করা, আনন্দের মুহূর্ত বানানো। আমাদের শিশু সন্তানেরা যেন ঈদকে আনন্দময় দিন হিসেবে উপভোগ করতে পারে। ঈদগাহের পাশাপাশি শিশুদের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, বিভিন্ন রাইড ও বিনোদনের ব্যবস্থা রাখা। আর এই আনন্দ করতে গিয়ে যেন মানুষ তাঁর মহান প্রতিপালককে ভুলে না যায় সেজন্য ঈদের দিনের দু’রাকাত সালাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আল্লাহু তা’আলা আ’লাম।
No Comment! Be the first one.