ফিকহের মাজহাবসমূহের বিকাশ
আল্লাহ বলেন:
إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا ٱلذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَـٰفِظُونَ
নিশ্চয়ই আমরাই ‘যিক্র’ (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি এবং নিশ্চয়ই আমরাই এর সংরক্ষক।
[সূরা আল-হিজর, ৯]
فَسْـَٔلُوٓا۟ أَهْلَ ٱلذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
তোমরা যদি না জানো, তাহলে আহলে যিক্রদেরকে জিজ্ঞেস করো।
[সূরা আন-নাহল, ৪৩]
আল্লাহর রাসূল ﷺ মু‘আযকে ইয়েমেনে পাঠালেন। তিনি বললেন: “তুমি কীভাবে ফয়সালা করবে?” মু‘আয বললেন: “আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী ফয়সালা করবো।” তিনি ﷺ বললেন: “যদি তা আল্লাহর কিতাবে না থাকে?” মু‘আয বললেন: “তাহলে আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহ অনুযায়ী।” তিনি ﷺ বললেন: “যদি তা আল্লাহর রাসূলের সুন্নাতেও না থাকে?” মু‘আয বললেন: “তাহলে আমি ইজতিহাদ করবো এবং কোনো প্রকার অপচেষ্টা করবো না।”
তিনি ﷺ বললেন: “সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আল্লাহর রাসূলের একজন দূতকে উপযুক্ত বানিয়েছেন।” [তিরমিজি]
ইমাম আল-আজুররি رحمه الله লিখেছেন:
“একজন মানুষ অন্ধকারে দিকহারা হয়ে হাঁটছে। এমন সময় একজন এসে একটি আলো জ্বালায়, যার কারণে মানুষ নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। ঠিক তেমনি একজন আলেম দুনিয়ার অন্ধকার এবং শয়তানের চক্রান্তের বিরুদ্ধে আল্লাহর দিকে যাওয়ার পথ আলোকিত করেন।”
যখন ইসলাম বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত হতে থাকে, সাহাবারা মদিনা থেকে শাসক, বিচারক এবং শিক্ষক হিসেবে ইসলাম শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন এবং আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। মানুষ যখন তাদের কাছে নতুন নতুন সমস্যার ব্যাপারে প্রশ্ন করত, তখন তারা কুরআন ও সুন্নাহ থেকে আহকাম নির্ধারণে নিজেদের সর্বোচ্চ বিচারশক্তি (ইজতিহাদ) প্রয়োগ করতেন—যেমনটি মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর ঘটনা থেকে বোঝা যায়। এই শীর্ষ সাহাবাদের অনেক ছাত্র ছিল, যারা আবার পরবর্তী প্রজন্মের ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন। এভাবেই প্রাথমিক ফিকহি ধারাগুলোর বিকাশ ঘটে।
সাহাবাদের পরবর্তী যুগের আলেমগণ শত শত বছর ধরে নিরলসভাবে দ্বীনের জ্ঞান সংগ্রহ, যাচাই, শ্রেণিবদ্ধকরণ, ব্যাখ্যা এবং শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে মানুষের কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করে গেছেন। অন্যান্য সব শাস্ত্রের মতো, দ্বীনেও কিছু আলেম তাঁদের যুগের অন্যদের তুলনায় বিভিন্ন বিষয়ে অধিক দক্ষতা ও নেতৃত্ব প্রদর্শন করেছেন। এই সকল আলেম কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে ফিকহ নির্ধারণ ও শিক্ষা দেওয়ার একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করতেন।
এই প্রাথমিক যুগের কিছু প্রখ্যাত ইমাম হলেনঃ
- ইব্রাহিম আন-নাখাঈ (মৃ. ৯৬ হিজরি) — কূফা
- সুফিয়ান আস-সাওরি (মৃ. ৯৭ হিজরি) — কূফা
- আবু ‘আমর আল-আওযাঈ (মৃ. ১৫৮ হিজরি) — বৃহত্তর শাম
- আবু হানিফা (মৃ. ১৫০ হিজরি) — কূফা
- লাইস ইবনে সা‘দ (মৃ. ১৭৫ হিজরি) — মিশর
- মালিক ইবনে আনাস (মৃ. ১৭৯ হিজরি) — মদিনা
- সুফিয়ান ইবনে উয়াইনাহ (মৃ. ১৯৮ হিজরি) — মক্কা
- মুহাম্মাদ ইবনে ইদরিস আশ-শাফিঈ (মৃ. ২০৪ হিজরি) — বাগদাদ ও মিশর
- আহমাদ ইবনে হাম্বল (মৃ. ২৪১ হিজরি) — বাগদাদ
- মুহাম্মাদ ইবনে জারীর আত-তাবারী (মৃ. ৩১০ হিজরি) — বাগদাদ
- দাউদ ইবনে আলী আয-জাহিরী (মৃ. ২৭০ হিজরি) — পারস্য
এ ছাড়াও আরও অনেক বিশিষ্ট আলেম ছিলেন। এই সকল আলেমদের ছাত্ররা তাঁদের ইমামের পদ্ধতিতে দ্বীন শেখানো অব্যাহত রাখেন এবং এই শিক্ষার সনদ বা ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন। এভাবেই গড়ে ওঠে মাযহাব বা ফিকহি স্কুল। “মাযহাব” শব্দের ভাষাগত অর্থ হলো “একটি পথ”, যা বোঝায় যে পরবর্তী যুগের আলেমরা কিভাবে তাঁদের ইমামের পদ্ধতি অনুসরণ করে মূল উৎস (কুরআন ও সুন্নাহ) থেকে আহকাম নির্ধারণ করেন।
কিছু মাযহাব সময়ের সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কারণ ঐ ইমামের কাজ যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি অথবা তাঁর ছাত্ররা তাঁদের শিক্ষকের কাজকে সামনে এগিয়ে নিতে পারেননি। আরও অনেক কারণ ছিল, যেমন:
- একই অঞ্চলে অন্য আলেমদের উপস্থিতি যারা অধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন,
- শাসক সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নির্দিষ্ট মাযহাবকে গ্রহণ বা প্রাধান্য দেওয়া ইত্যাদি, যা বিভিন্ন স্থানে একটি নির্দিষ্ট মাযহাবের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রভাবিত করেছে।
আজ বিশ্বজুড়ে চারটি প্রধান মাযহাব বিদ্যমান, যথা:
- ইমাম আবু হানিফা (রহ.)
- ইমাম মালিক (রহ.)
- ইমাম আশ-শাফি’ঈ (রহ.)
- ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) এর মাযহাবসমূহ।
উম্মাহ এই সকল ইমামদের জ্ঞান ও মর্যাদা সম্পর্কে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এই চারটি মাযহাবের রয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলা ধারাবাহিক গবেষণা, পর্যালোচনা, শিক্ষা, এবং বহুস্তরের বিভিন্ন বই রচনার ইতিহাস—যেখানে শত শত আলেম এই মাযহাবের ব্যাখ্যা, পদ্ধতি, এবং দলীলসমূহ তুলে ধরেছেন।
এই আলেমদের কাজ ও মাযহাবসমূহকে কেবল ব্যক্তিগত মতামতের সংকলন হিসেবে উপস্থাপন করা কিংবা এগুলো কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয় বলে প্রচার করা—এটি একটি চরম বিকৃতি এবং স্পষ্ট মিথ্যাচার।
চারটি প্রসিদ্ধ মাযহাব প্রত্যেকটিই সাহাবাদের মধ্যকার শীর্ষস্থানীয় আলেমদের দিকে তাদের জ্ঞানগত শিকড় গুঁজে ধরে।
সবকিছু একত্রে জড়িত
অনেক সময় আমরা দেখি যে মাযহাব অনুসারীরা নিজেদের মাযহাব অনুসরণে অতিরঞ্জিত হয়ে পড়ে। তারা অন্যদের আক্রমণ করে, বদনাম করে এবং মাযহাবের নামে সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করে। কিন্তু এরা একটি সীমিত গোষ্ঠী, যাদের জ্ঞান নেই এবং যারা বৃহত্তর মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে না। বাস্তবে, আমরা দেখি কিভাবে ইমামগণ একে অপরকে চরম সম্মান ও ভালোবাসা দেখিয়েছেন।
ইমাম আবু হানিফা رحمه الله তাঁর প্রধান ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ رحمه الله-কে মাদীনায় ইমাম মালিক رحمه الله-এর কাছে পাঠান। ইমাম আবু ইউসুফ হাদিসের ক্ষেত্রে ইমাম মালিকের পদ্ধতি শিখেন, এবং আমরা দেখি হানাফি মাযহাবে এর প্রভাব দলিল উপস্থাপনে রয়েছে। কাজি আবু ইউসুফ পরবর্তীতে মুসলিম উম্মাহর প্রথম প্রধান বিচারপতি (ক্বাযী আল-কুওদাত) হন। ইমাম মুহাম্মাদ আশ-শায়বানী رحمه الله -ও ইমাম মালিকের সাথে তিন বছর ইলম অর্জন করেন।
ইমাম আশ-শাফি’ঈ رحمه الله মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন ইমাম আবু হানিফা’র ওফাতের বছর, ১৫০ হিজরিতে। ইমাম আশ-শাফি’ঈ মাদীনায় ইমাম মালিকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং দশ বছর বয়সেই তাঁর বিখ্যাত মুওয়াত্তা মুখস্থ করে ফেলেন। ইমাম মালিক ৪০ বছর ধরে মসজিদে নববীতে মুওয়াত্তা পড়াতেন। পরবর্তীতে ইমাম আশ-শাফি’ঈ ২৯ বছর বয়সে বাগদাদে চলে যান, যেখানে তিনি ইমাম মুহাম্মাদ আশ-শায়বানীর কাছ থেকে ইলম গ্রহণ করেন।
ইমাম আহমাদ رحمه الله বাগদাদের আলেমদের থেকে ইলম অর্জন করেন। তিনি ১৬ বছর বয়সে হাদিস শিখা শুরু করেন—এটাই ছিল ইমাম মালিকের মৃত্যুর বছর। বাসরার ইমাম হাম্মাদ ইবনে যায়দ-ও ঐ বছরই ইন্তেকাল করেন। ইমাম আহমাদ সফর করে ইলম অর্জন করেন ইমাম সুফিয়ান ইবনে উয়াইয়ানা, আশ-শাফি’ঈ এবং কাজি আবু ইউসুফের নিকট থেকে।
ইমাম আশ-শাফি’ঈ এবং ইমাম আহমাদের মাঝে ভালোবাসা ও সম্মানের সম্পর্ক সুপরিচিত।
ইমাম আশ-শাফি’ঈ বলেন:
“আমি যখন বাগদাদ ত্যাগ করি, আমার পেছনে আহমাদ ইবনে হাম্বল-এর চেয়ে অধিক গুণসম্পন্ন, অধিক জ্ঞানী ও অধিক আলিম কাউকে রেখে আসিনি।”
ইমাম আহমাদ ইমাম আশ-শাফি’ঈ -এর ছেলের কাছে বলেন:
“তোমার পিতা হলেন সেই ছয়জনের একজন, যাদের জন্য আমি প্রতিটি রাত আল্লাহর কাছে পুরস্কার চেয়ে দোআ করি।”
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন: ইমাম বুখারি, ইমাম আবু দাউদ, আরো অনেকে। ইমাম বুখারি رحمه الله যখন তাঁর সহিহ বুখারি সম্পন্ন করেন, তখন ইমাম আহমাদের নিকট তা পর্যালোচনার জন্য পেশ করেন।
ইমাম আস-সাফফারিনী আল-হাম্বলি رحمه الله বলেন,
وهل كتبُ الفقه إلا زُبدة الكتاب والسُّنة وثمرتُها؟
“ফিকহের কিতাবসমূহ কি কুরআন ও সুন্নাহর সারাংশ ও তাদের ফল নয়?” [জাওয়াব আল সাফফিরিনি]
অনেক সময় পাঠক হিসেবে আমরা হাদিসের মর্মবাণীর উপর মনোযোগ দিই, কিন্তু সেই সনদ বা বর্ণনা-শৃঙ্খলের দিকে লক্ষ্য দিই না যার মাধ্যমে সেই হাদিস আমাদের কাছে পৌঁছায়। অথচ তাতেই রয়েছে এক ভিন্ন ধরণের সৌন্দর্য— হাজার বছরের ইলমের ঐতিহ্য, প্রকৃত মুসলিম নায়কদের উত্তরাধিকার, সুন্নাহ সংরক্ষণের জন্য তাঁদের কঠোর পরিশ্রম, ত্যাগ, এবং অক্লান্ত প্রচেষ্টা।
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ إِدْرِيسَ عَنْ مَالِكٍ عَنِ ابْنِ شِهَابٍ عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ كَعْبِ بْنِ مَالِكٍ أَنَّهُ أَخْبَرَهُ أَنَّ أَبَاهُ كَعْبَ بْنَ مَالِكٍ كَانَ يُحَدِّثُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ:
«إِنَّمَا نَسَمَةُ الْمُؤْمِنِ طَائِرٌ يَعْلُقُ فِي شَجَرِ الْجَنَّةِ حَتَّى يُرْجِعَهُ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى إِلَى جَسَدِهِ يَوْمَ يَبْعَثُهُ»ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল رحمه الله তাঁর মুসনাদ-এ বর্ণনা করেন, মুহাম্মাদ ইবনে ইদরিস (আশ-শাফি’ঈ) আমাদেরকে বর্ণনা করেছেন, মালিক (ইবনে আনাস) থেকে, ইবনে শিহাব (আয-যুহরী) থেকে, আবদুর রহমান ইবনে কা‘ব ইবনে মালিক থেকে, যিনি তাঁকে জানিয়েছেন যে, তাঁর পিতা কা‘ব ইবনে মালিক বলতেন, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “মুমিনের আত্মা জান্নাতের বৃক্ষের মাঝে একটি পাখি হিসেবে থাকে, যতক্ষণ না আল্লাহ — মহান ও বরকতময় — কিয়ামতের দিনে তা দেহে ফিরিয়ে দেন।” এই সনদে ফিকহের চার ইমামের মধ্যে তিনজনই রয়েছেন। আর ইমাম আয-যুহরী হলেন এমন একজন আলিম, যাঁকে “ইমামদের ইমাম” বলা হয়। তাঁর মর্যাদা বোঝাতে কিছু শিষ্যের নামই যথেষ্ট, যেমন:
- ইমাম মালিক ইবনে আনাস
- সুফিয়ান ইবনে উয়াইয়ানা
- লায়স ইবনে সা‘দ
- ইবনে জুরাইজ এবং আরও অনেকে।
দিনশেষে, প্রত্যেক সাধারণ মুসলমানকে একটি বিষয়ে জ্ঞান রাখতে হবে— যদি কেউ কুরআন ও সুন্নাহ থেকে সরাসরি মাসআলা আহরণ করার যোগ্যতা না রাখেন, তাহলে তাঁকে অবশ্যই ইলমওয়ালাদের শরনাপন্ন হতে হবে। এই যোগ্যতা অর্জন করতে বছরের পর বছর পরিশ্রম, ইলম, গবেষণা লাগে, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এই মর্যাদাবান ইমামগণ যখন “কুরআন ও সুন্নাহ থেকে নেওয়া”-র কথা বলতেন, তাঁরা তাঁদের ছাত্র ও আলিমদের উদ্দেশ্যেই বলতেন— সাধারণ জনগণের উদ্দেশ্যে নয়।
সুলাসিয়াত (الثلاثيات)
হাদিসের ইমামগণ চেষ্টা করতেন সবচেয়ে ছোট সনদ (chain of narration) অর্জন করার জন্য। তাঁরা এ উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্ত সফর করতেন। কম সনদবিশিষ্ট হাদিসকে অধিক নির্ভরযোগ্য মনে করা হয় কারণ সনদ যত ছোট হয়, ভুল বা বিভ্রান্তির সম্ভাবনা ততই কমে। সুলাসিয়াত হাদিস বলতে ঐসব হাদিসকে বোঝানো হয় যেগুলোর সনদে তিনজন মাত্র বর্ণনাকারী থাকেন, যাদের মাধ্যমে হাদিস পৌঁছায় রাসূলুল্লাহ ﷺ পর্যন্ত। এই তিনজন হচ্ছেন:
- একজন সহাবি
- একজন তাবি‘ঈ
- একজন তাবি‘ঈ আত-তাবি‘ঈ
ইমাম আল-বুখারী رحمه الله এর বিখ্যাত সহিহ গ্রন্থে তিনি ২২টি সুলাসিয়াত হাদিস বর্ণনা করেছেন। এই সুলাসিয়াত-গুলোকে আলেমগণ “ইমাম বুখারীর গর্ব” বলে থাকেন কারণ এতে ইমাম বুখারী رحمه الله ও রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মাঝে সংক্ষিপ্ত সনদ রয়েছে।
ইমাম আল-বুখারী رحمه الله তাঁর সহিহ-এ বর্ণনা করেছেন: “আমাকে আল-মাক্কি ইবনে ইব্রাহিম বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন: ইয়াযিদ ইবনে আবি উবায়দ বর্ণনা করেছেন সালামা ইবনুল আকওয়া’ رضى الله عنه থেকে, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি, “যে ব্যক্তি আমার নামে এমন কথা বলবে যা আমি বলিনি, সে যেন জাহান্নামে নিজের আসন ঠিক করে নেয়।”
এটি ইমাম বুখারীর সুলাসিয়াত হাদিসসমূহের প্রথম হাদিস এবং এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিশুদ্ধতম হাদিসসমূহের মধ্যে অন্যতম।
একটি দারুন তথ্য হলো— ইমাম বুখারী رحمه الله তাঁর অর্ধেক সুলাসিয়াত হাদিসই বর্ণনা করেছেন তাঁর উস্তাদ শাইখ আল-মাক্কি ইবনে ইব্রাহিম رحمه الله -এর মাধ্যমে। এই শাইখ আল-মাক্কি ইবনে ইব্রাহিম ছিলেন ইমাম আবু হানীফা رحمه الله -এর ছাত্র। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল رحمه الله এবং ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া আল-লায়সি رحمه الله -ও এই শাইখের থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমাদ رحمه الله -ও তাঁর বিখ্যাত কিতাব “আল-মুসনাদ”-এ সুলাসিয়াত হাদিস বর্ণনা করেছেন। এই হাদিসসমূহের সংখ্যা ৩৩২টি।
এই হাদিসসমূহকে একত্র করেছেন আল-আল্লামা ইমাম আস-সাফফারিনী আল-হাম্বলি رحمه الله এবং তিনি এগুলোর উপর একটি বিশদ ব্যাখ্যাও লিখেছেন।
হাদিসের ছয় কিতাব (The Six Books of Hadith)
নবিজি ﷺ -কে সাহাবিগণ (رضي الله عنهم) এমনভাবে জানতেন ও অনুসরণ করতেন যে, তিনি কীভাবে হাত ধুতেন, হাঁটতেন, হাসতেন, ঘুমাতেন, পরিবারের সাথে কেমন আচরণ করতেন— সব কিছু আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়— এমন সুসংরক্ষিত জীবনী পৃথিবীর কোনো মহান নেতারই নেই। নবিজি ﷺ-র যুগেই তাঁর হাদিস লিখে রাখা শুরু হয়।
উদাহরণস্বরূপ:
- আবদুল্লাহ ইবনে ‘আমর ইবনে আল-আস তাঁর হাতে লেখা একটি হাদিসের সঙ্কলন রাখতেন যার নাম ছিল আস-সহিফাহ আস-সাদিকাহ — যাতে প্রায় ১,০০০টি হাদিস ছিল। এই হাদিসসমূহ পরে ইমাম আহমাদ-এর “আল-মুসনাদ”-এ সংকলিত হয়।
- অপর আরেকটি বিখ্যাত সঙ্কলন ছিল হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহ-এর, যিনি আবু হুরাইরা رضي الله عنه থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং তার সঙ্কলনে প্রায় ১৩৮টি হাদিস ছিল।
সুন্নাহ লিখিত ও মৌখিকভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সংরক্ষিত ও স্থানান্তরিত হতে থাকে। উমার ইবনে আবদুল আজীয رحمه الله তাঁর খেলাফতের সময় পুরো সাম্রাজ্যজুড়ে আদেশ পাঠান, বিশেষ করে মাদীনায়, যেন রাসূলুল্লাহ ﷺ এর হাদিসসমূহ সংকলিত হয়। এই নির্দেশেই ইমাম আয-যুহরী رحمه الله ছিলেন প্রথমদিকের হাদিস সংকলক। এরপর আসে সংকলনের যুগ। হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীতে ইমাম মালিক رحمه الله সর্বপ্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ কিতাব সংকলন করেন, যা আহকাম ও হাদিস নির্ভর ফিকহি গ্রন্থ ছিল — তাতে প্রায় ১,৭২০টি হাদিস রয়েছে। তখন এটিই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হাদিসগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হতো।
তৃতীয় শতাব্দীতে আসে এমন এক কিতাব, যা আজও অতুলনীয়— তা হলো ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের “আল-মুসনাদ”, যাতে প্রায় ৩০,০০০ হাদিস রয়েছে।
এরপর আমরা পাই সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ছয়টি হাদিসের কিতাব, যেগুলোকে বলা হয়: আল-কুতুব আস-সিত্তাহ (الكتب الستة) (বা ভুল করে যেটিকে অনেকে আস-সিহাহ আস-সিত্তাহ বলে) তবে মনে রাখা দরকার — এই ছয়টি কিতাবের সব হাদিসই সহিহ নয়, তাই “আস-সিহাহ আস-সিত্তাহ” বলা প্রকৃত অর্থে ভুল।
১. সহিহ আল-বুখারী
আসল শিরোনাম: الجامع المسند الصحيح المختصر من أمور رسول الله صلى الله عليه وسلم وسننه وأيامه
(আল-জামি‘ আল-মুসনাদ আস-সহিহ আল-মুখতাসার মিন উমূর রাসূলিল্লাহ ﷺ ওয়া সুনানিহি ওয়া আইয়ামিহি)
লেখক: আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইব্রাহিম ইবনে আল-মুগীরাহ ইবনে বারদিযবাহ আল-জুফী আল-বুখারী رحمه الله (মৃত্যু: ২৫৬ হিজরী)। তিনি ছিলেন বুখারার অধিবাসী, যা বর্তমান উজবেকিস্তানের একটি শহর।
মোট হাদিসের সংখ্যা: ৭,৩৯৭টি
সংকলনে সময় লেগেছে: ১৫ বছর
২. সহিহ মুসলিম
আসল শিরোনাম: المسند الصحيح المختصر من السنن بنقل العدل عن العدل إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم
(আল-মুসনাদ আস-সহিহ আল-মুখতাসার মিন আস-সুনান বি নাকল আল-‘আদল ‘আন আল-‘আদল ইলা রাসূলিল্লাহ ﷺ)
লেখক: আবু আল-হুসাইন মুসলিম ইবনে আল-হজ্জাজ ইবনে মুসলিম আল-কুশাইরি আন-নিশাপুরী رحمه الله (মৃত্যু: ২৬১ হিজরী)। তিনি ছিলেন নিশাপুর (বর্তমান উত্তর-পূর্ব ইরান)-এর অধিবাসী।
মোট হাদিসের সংখ্যা: ৭,২৭৫টি
সংকলনে সময় লেগেছে: ১৫ বছর
৩. জামে‘ আত-তিরমিজি (বা সুনান আত-তিরমিজি)
আসল শিরোনাম: الجامع المختصر من السنن عن رسول الله صلى الله عليه وسلم ومعرفة الصحيح والمعلول وما عليه العمل
(আল-জামি‘ আল-মুখতাসার মিন আস-সুনান ‘আন রাসূলিল্লাহ ﷺ ওয়া মা‘রিফাত আস-সহিহ ওয়াল-মা‘লূল ওয়া মা ‘আলাইহিল-‘আমল)
লেখক: আবু ‘ঈসা মুহাম্মাদ ইবনে ‘ঈসা ইবনে সাওরাহ ইবনে মূসা ইবনে আদ-দাহহাক আস-সুলামী আত-তিরমিজি رحمه الله (মৃত্যু: ২৭৯ হিজরী)। তিনি ছিলেন তিরমিজ নামক শহরের অধিবাসী, যা বর্তমান উজবেকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত।
মোট হাদিসের সংখ্যা: ৪,৩১৮টি
মজার তথ্য:
- ইমাম আত-তিরমিজি رحمه الله ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম এবং ইমাম আবু দাউদ-এর ছাত্র ছিলেন।
- তিনি তাঁর গ্রন্থে ইমাম বুখারীর নাম উল্লেখ করেছেন ১১৪ বার।
- ইমাম আত-তিরমিজি এমন এক অবস্থানে পৌঁছেছিলেন যে, তাঁর শিক্ষকগণ তাঁর থেকেই হাদিস বর্ণনা করেছেন।
- ইমাম বুখারী رحمه الله তাঁর সহিহ-এ ২টি হাদিস ইমাম আত-তিরমিজি থেকে বর্ণনা করেছেন এবং
ইমাম মুসলিম رحمه الله ১টি হাদিস বর্ণনা করেছেন তাঁর থেকে। - একবার ইমাম বুখারী رحمه الله তাঁকে বলেছিলেন: “তুমি আমার কাছ থেকে যতটুকু উপকার পেয়েছ, আমি তোমার থেকে তার চেয়েও বেশি উপকার পেয়েছি।”

৪. সুনান আন-নাসায়ি
আসল শিরোনাম: السنن الصغرى (বা المجتبى)
লেখক: আবু আবদুর রহমান আহমাদ ইবনে শু‘আইব ইবনে আলী আন-নাসায়ি رحمه الله (মৃত্যু: ৩০৩ হিজরী)।
তিনি ছিলেন নাসা শহরের অধিবাসী, যা ছিল খোরাসানের অন্তর্গত — প্রাচীন বৃহত্তর ইরানের উত্তর-পূর্বাংশে।
মোট হাদিসের সংখ্যা: ৫,৮০৩টি
৫. সুনান আবু দাউদ
লেখক: আবু দাউদ সুলাইমান ইবনে আল-আশ‘আথ আল-আযদী আস-সিজিস্তানী رحمه الله (মৃত্যু: ২৭৫ হিজরী)।
তিনি ছিলেন সিজিস্তান নামক অঞ্চল থেকে, যা বর্তমানে পূর্ব ইরান ও দক্ষিণ-পশ্চিম আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত।
মোট হাদিসের সংখ্যা: ৫,১৮৫টি
সংকলনে সময় লেগেছে: ২০ বছর
৬. সুনান ইবনে মাজাহ
লেখক:
ইবনে মাজাহ, আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াযীদ আর-রাব‘ঈ আল-কাজভিনী رحمه الله (মৃত্যু: ২৭৩ হিজরী)।
তিনি ছিলেন কাজভিন শহরের অধিবাসী, যা বর্তমান ইরানের একটি শহর।
মোট হাদিসের সংখ্যা: ৪,৩৪১টি
হাদিস বর্ণনাকারী প্রধান সাহাবীগণ
সাতজন সাহাবী (رضي الله عنهم) আছেন, যারা রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে সর্বাধিক হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাঁরা হলেন:
১. আবূ হুরাইরাহ رضي الله عنه (মৃত্যু: ৫৯ হিজরী)
হাদিসের সংখ্যা: ৫,৩৭৪টি
তিনি নিজেই হাদিস লিখে রেখেছিলেন এবং অন্যদের দিয়েও নিজের থেকে হাদিস লিখিয়েছিলেন। বর্ণিত আছে যে, তাঁর নিজের জন্য অনেক হাদিসের বই লেখা হয়েছিল। নয়জনের বেশি ছাত্র তাঁর থেকে হাদিস লিখে নিজেদের সংগ্রহ তৈরি করেছিলেন।
২. আবদুল্লাহ ইবনে ‘উমর رضي الله عنهما (মৃত্যু: ৭৩ হিজরী)
হাদিসের সংখ্যা: ২,৬৩০টি
তিনি নিজে হাদিস লিপিবদ্ধ করেছিলেন এবং অন্তত আটজন ছাত্র তাঁর থেকে হাদিস লিখে নিয়েছিলেন।
৩. আনাস ইবনে মালিক رضي الله عنه (মৃত্যু: ৯৩ হিজরী)
হাদিসের সংখ্যা: ২,২৮৬টি
১৬ জন ব্যক্তি সরাসরি তাঁর থেকে হাদিস লিখে নিয়েছেন বলে বর্ণিত আছে।
৪. আয়েশা বিনত আবূ বকর رضي الله عنها (মৃত্যু: ৫৮ হিজরী)
হাদিসের সংখ্যা: ২,২১০টি
তাঁর ভাগ্নে ‘ঊরওয়াহ, এবং বিখ্যাত আমরাহ বিনত আবদুর রহমানসহ তিনজনের বেশি ব্যক্তি তাঁর থেকে হাদিস লিখেছেন।
৫. আবদুল্লাহ ইবনে ‘আব্বাস رضي الله عنهما (মৃত্যু: ৬৮ হিজরী)
হাদিসের সংখ্যা: ১,৬৬০টি
নয়জনের বেশি ছাত্র তাঁর থেকে হাদিস লিখে নিয়েছেন। বর্ণিত আছে, তাঁর মৃত্যুর সময় এমন পরিমাণ হাদিসের পুস্তক ছিল, যা একটি উটের পিঠে বহন করা লাগত।
৬. জাবির ইবনে আবদুল্লাহ رضي الله عنه (মৃত্যু: ৭৮ হিজরী)
হাদিসের সংখ্যা: ১,৫৪০টি
তাঁর ছাত্র ওয়াহ্ব ইবনে মুনাব্বিহ তাঁর থেকে হাদিস লিখে সাহিফা আকারে সংকলন করেছিলেন, যা মূলত হজ সংক্রান্ত হাদিসসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করে।
৭. আবু সাঈদ আল-খুদরি (সা‘দ ইবনে মালিক) رضي الله عنه (মৃত্যু: ৭৪ হিজরী)
হাদিসের সংখ্যা: ১,১৭০টি
আল্লাহ তা’য়ালা তাঁদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট হোন। এই সাত সাহাবীর নাম মুখস্থ রাখার সহজ উপায় একটি কবিতা মনে রাখা যথেষ্ট, কবিতাটি নিম্নরূপ:
سَبْعٌ مِنَ الصَّحْبِ فَوْقَ الأَلْفِ قَدْ نَقَلُوا
مِنَ الحَدِيثِ عَنِ المُختَارِ خَيْرُ مُضَرْ
أَبُو هُرَيرَةَ سَعْدٌ جَابِرٌ أَنَسٌ
صِدِّيقَةٌ وَابْنُ عَبَّاسٍ كَذَا ابنُ عُمَرْ
অনুবাদ: “ সাতজন সাহাবি, হাজারেরও বেশি হাদিস বলেছেন, নবীজি ﷺ–এর কাছ থেকে, যিনি ছিলেন মুদার গোত্রের সেরা। [১]
আবু হুরাইরা, সা‘দ, জাবির আর আনাস,
সচ্চরিত্রা ‘আয়েশা, ইবনু আব্বাস আর ইবনু ‘উমার।”

হাদিস বর্ণনা করা ও সংরক্ষণের ফজীলত
জায়েদ ইবনে থানিত رضي الله عنه থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি:
“نَضَّرَ اللَّهُ امْرَأً سَمِعَ مِنَّا حَدِيثًا فَحَفِظَهُ حَتَّى يُبَلِّغَهُ، فَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ إِلَى مَنْ هُوَ أَفْقَهُ مِنْهُ، وَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ لَيْسَ بِفَقِيهٍ”
“আল্লাহ তা’আলা সেই ব্যক্তির চেহারা আনন্দ-উজ্জ্বল করুন, যে আমার কোন কথা শুনেছে, তারপর তা সঠিকভাবে মনে রেখেছে এবং সেভাবেই অন্যের নিকট পৌছে দিয়েছে। এমন অনেক লোক আছে, যারা নিজেদের তুলনায় উচ্চতর জ্ঞানের অধিকারীর নিকট জ্ঞান পৌছে দিতে পারে। আর অনেক জ্ঞানের বাহক এমন রয়েছে যারা নিজেরাই জ্ঞানী নয়।”
[আবু দাউদ]
ইমাম সুফিয়ান ইবনে ‘উয়াইনা رحمه الله এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, “আমি হাদিসের ছাত্রদের সবসময়ই খুব তরুণ চেহারার দেখেছি।” আল্লাহ আমাদেরকে এই মহাপুরুষদের পথ অনুসরণ করার তাওফীক দিন, আর তাঁদের কর্মের সামান্য অংশ হলেও আমাদের মাঝে বাস্তবায়ন করুন।
ফুটনোট:
[১] মুদার গোত্রের সেরা বলা হয়েছে কারণ নবীজি ﷺ মুদারের বংশধর ছিলেন এবং সেই গোত্রে তাঁর চেয়ে মর্যাদাবান, পূণ্যবান, ও শ্রেষ্ঠ আর কেউ ছিলেন না। তাই এটি তাঁর জন্য একটি সম্মানসূচক উপাধি।
No Comment! Be the first one.