রমাদান এলো এবং অনেক দ্রুত শেষ গেল। আমাদের মধ্যে অনেকেই এর সম্পূর্ণ উপকার লাভ করতে পারিনি, আবার কেউ কেউ কামনা করছিলাম যদি রমাদান আরেকটু বেশি সময়ের জন্য আমাদের অতিথি হতো। আল্লাহ যেহেতু আমাদের স্রষ্টা তিনিই আমাদের সবেচেয়ে ভালো জানেন। তাই আমাদের সাহায্য করতে, শুধুমাত্র এক মাসের জন্য নয় বরং পুরো বছর জুড়ে আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়ার জন্য, আল্লাহ বিভিন্ন সময়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন যেন এগুলো আমাদের ভেতর উৎসাহের ধারা অব্যাহত রাখে। এখন, আমরা সেইরকম একটি মাসে প্রবেশ করলাম – জিলহজ মাস।
আল্লাহ বলেন:
إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِندَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَٰلِ
“আসমান-যমীন সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর কিতাবে (লাউহে মাহফুজে) মাসগুলোর সংখ্যা হল বার। তার মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস। এটা হল সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন। কাজেই ঐ সময়ের মধ্যে নিজেদের উপর যুলম করো না। মুশরিকদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ কর, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করে। জেনে রেখ, আল্লাহ অবশ্যই মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন।”
[সূরা তাওবাহ, ৩৬]
জিলহজ হলো ইসলামিক ক্যালেন্ডার এর চারটি পবিত্র ও সম্মানিত মাসের একটি, যখন যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ, এছাড়া অন্যান্য মাসগুলো হলো জিলকদ, মুহাররম এবং রজব। ইবন আব্বাস رضي الله عنه বলেন, “জিলহজের চেয়ে অধিক পবিত্র ও মহিমান্বিত কোনো মাস নেই।”
জিলহজের প্রথম অংশ, অর্থাৎ প্রথম ১০ দিন, সবচেয়ে উপকারী এবং বরকতময়। আল্লাহ ﷻ বলেন:
وَالْفَجْرِ وَلَيَالٍ عَشْرٍ
ফজরের শপথ; দশ রাতের শপথ।
[সূরা ফজর, ১-২]
ইবন আব্বাস, ইবন আল-জুবাইর, মুজাহিদ এবং পূর্ববর্তী ও পরবর্তী প্রজন্মের অন্যান্যরা বলেন যে এটি জিলহজের প্রথম ১০ দিনকেই নির্দেশ করে।
[তাফসির ইবনে কাসির]
সাধারণত কেউ যদি কিছু দ্বারা কসম করে, তাহলে সেই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। এখানেও আল্লাহ নিজে, সমস্ত রাজাদের চেয়ে শক্তিশালী রাজা, দশ রজনির শপথ করছেন। তাই এর গুরুত্ব ও পুরস্কার এতটাই বড় হওয়া উচিত যা শুধু কল্পনাতেই সম্ভব।
আবু উসমান আন-নাহদি حمه الله বলতেন, “সালাফরা তিনটি দশকে অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন: মুহাররমের প্রথম দশ, জিলহজের প্রথম দশ, এবং রমজানের শেষ দশ রজনি।”
[আদ-দুরার আল মানসুর]
আমাদের নবি ﷺ এই পবিত্র দিনগুলো সম্পর্কে বলেন: “এই দশ দিনের চেয়ে উত্তম কোনো দিন নেই যাতে আমলসমূহ আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়।” লোকেরা জিজ্ঞেস করল, “আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করলেও না?”
তিনিﷺ বললেন, “আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করলেও না, শুধু সেই ব্যতিক্রম—যে ব্যক্তি নিজের প্রাণ ও সম্পদ নিয়ে বের হয় এবং কিছুই নিয়ে ফিরে আসে না।”
[বুখারি]
জিহাদ ইসলামের সবচেয়ে মহৎ ইবাদতের একটি, কিন্তু নবি ﷺ আমাদের জানিয়েছেন যে, এই দশ দিনে করা সৎকর্ম এমনকি জিহাদের চেয়েও উত্তম, যদি না কেউ জিহাদে নিজের সবকিছু বিলিয়ে দেয়।
ইমাম ইবন রজব رحمه الله বলেন,
“যে ব্যক্তি আসন্ন বছর হজ পালনে অক্ষম, সে যেন জিলহজের প্রথম দশ দিনকে মহান মনে করে এবং বাড়িতে থেকেই সৎকর্ম সম্পাদন করে। এটি জিহাদের চেয়েও অধিক ফজিলতপূর্ণ, অথচ জিহাদ নিজেই হজের চেয়েও বেশি ফজিলতপূর্ণ।”
তিনি আরও বলেন,
“এই হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, এই দশ দিনে করা আমলসমূহ আল্লাহর কাছে পৃথিবীর অন্য যে কোনো দিনের চেয়ে বেশি প্রিয়। আর যখন এগুলো আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয়, তখন অবশ্যই এগুলোই তাঁর নিকট সবচেয়ে উত্তম।”
[লাতায়ফুল মা’আরিফ]
হাফিয ইবন হাজর رحمه الله বলেন,
“এই দশ দিনের মর্যাদা এই কারণে যে, এই সময়ে ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলো একত্রে সংঘটিত হয়: নামাজ, রোযা, দান এবং সর্ববৃহৎ ইবাদত—হজ। এই আমলগুলো নির্দিষ্টভাবে এই সময়ে সংঘটিত হয়, তাই এই দিনগুলোর ফজিলত ও গুরুত্ব অধিক।”
[ফাতহুল বারী]
যারা হজের শর্ত পূরণ করেছে, আল্লাহ তাদের উপর জীবনে একবার হজ ফরজ করেছেন। যারা হজে যাচ্ছে না, তাদের জন্য আল্লাহ জিলহজের এই প্রথম ১০ দিনকে সমান মর্যাদাসম্পন্ন করে দিয়েছেন। এই মানুষগুলো অনেক কিছুতেই মক্কার হাজিদের অনুসরণ করেন, যেমন আল্লাহর জিকির বাড়ানো, কোরবানির পশু প্রস্তুত করা, চুল কাটা এবং নখ কাটা থেকে বিরত থাকা, ঠিক যেমন হাজিরা ইহরাম বাধা অবস্থায় করে থাকেন।
আল্লাহর রাসুল ﷺ তাঁর বিদায় ভাষণে বলেন, “তোমরা কি জানো কোন মাস সর্বোত্তম?” তারা বললো, “নিশ্চয়ই, আমাদের এই মাস, অর্থাৎ জিলহজ।” তিনি বললেন, “তোমরা কোন শহরকে সর্বোত্তম বলে জানো?” তারা বললো, “নিশ্চয়ই, আমাদের শহর, মক্কা।” তিনি আরও বললেন, “তোমরা কোন দিনকে সর্বোত্তম বলে জানো?” তারা বললো, “নিশ্চয়ই, এই দিন, অর্থাৎ আরাফাতের দিন।”
[বুখারি]
কিন্তু রমজানের শেষ ১০ দিন কি বছরের সেরা দিন নয়? আমি শুরুতেই বলেছি, আল্লাহ আমাদের সবসময় উৎসাহ বা লাইফ হ্যাক দেন। রমাদান সে রাতকে ধারণ করে যা মর্যাদাসম্পন্ন লাইলাতুল কদর, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম, এবং এই কারণে শেষ দশ রজনি বছরের সবথেকে মহিমান্বিত রাত। অন্যদিকে জিলহজ্ব ধারণ করে আরাফার দিনকে, যা বছরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিন, যেদিন আল্লাহর ইচ্ছায় আগের ও পরবর্তী বছরের গুনাহ ক্ষমা পাওয়া যায়, যেদিন হাজিরা তাদের রবের দরবারে রহমত প্রার্থনা করে। এই দিনগুলো বছরের সেরা দিন। আল্লামা ইবনে তাইমিয়াহ رحمه الله বলেন, “জিলহজের (প্রথম) দশ দিন রমজানের (শেষ) দশ দিনের চেয়ে বেশি ফজিলতপূর্ণ।”
[ফাতহুল বারী]
যেমন আমরা রমজানের শেষ ১০ দিনের মধ্যে ‘বিস্ট মোড’ চালিয়েছিলাম, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যতটা পারতাম চেষ্টা করেছিলাম, জিলহজের মত এরকম বড় সুযোগও তাই আমাদের মিস করা উচিত হবে না।
এই দিনগুলোর বিষয়ে বহু হাদিস এবং আয়াত প্রমাণ করে যে, এ সময়ে করা প্রতিটি ভাল কাজ আল্লাহর কাছে অন্য সময়ের তুলনায় বেশি প্রিয়। যেমন ভালো কাজের সওয়াব এ সময়ে বহুগুণ বাড়ে, তাই হারাম মাসে খারাপ কাজগুলিও গুরুতরভাবে বিচার করা হয় কারণ সময়টি পবিত্র। কাতাদাহ رضي الله عنه বলেন, “জেনে রাখা উচিত যে, মহিমান্বিত মাসগুলোতে (জিলকদ, জিলহজ, মুহাররম এবং রজব) পাপাচার অন্য সময়ের চেয়ে খারাপ, যদিও সব পরিস্থিতিতে পাপকে হালকা মনে করা উচিত না (মারাত্মক বিষয়); তবে আল্লাহ তার পছন্দের বিষয়গুলোকে মহিমান্বিত করেন।”
[তাফসির ইবনে কাসির]
এই ১০ দিনের মধ্যে যে শুক্রবার আসে তা বছরের অন্য যেকোনো শুক্রবার থেকে এর ফজিলত বহুগুণ বেড়ে যায়। ইমাম ইবন হজর আল-আশকালান رحمه الله বলেন, “জিলহজের ১০ দিনের মধ্যে পড়া শুক্রবার বছরের অন্য যে কোনও শুক্রবারের চেয়ে উত্তম।”
[ফাতহুল বারী]
এছাড়া এটাও মনে রাখতে হবে যে, যারা এই দিনগুলোতে পশু কুরবানি দিতে চান, তাদের জন্য শরীরের কোনো অংশের চুল কাটা অথবা শেভ করা, চামড়ার কোনো অংশ কাটা অথবা নখ কাটার অনুমতি নেই। এটি তার পরিবারের জন্য প্রযোজ্য নয়, শুধুমাত্র পরিবারের প্রধান ব্যক্তি যিনি কুরবানি করবেন তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। নবি ﷺ বলেছেন, “যখন তুমি জিলহজের নতুন চাঁদ দেখ, এবং তোমাদের মধ্যে কেউ কুরবানি করতে চায়, সে যেন কুরবানি করা পর্যন্ত তাঁর চুল কাটা ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে।” অন্য বর্ণনায় বলেন, “সে যেন তার চুল ও ত্বক স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকে।”
[মুসলিম]
যে নিজে ছাড়া অন্যের জন্য কুরবানি করে, উত্তরাধিকারসূত্রে বা আমানতসরূপ, তার জন্য মাথা, নখ বা ত্বক থেকে কিছু কাটার অনুমতি আছে কারণ এটি তার কুরবানি নয়। এই বিধান কুরবানি করা ব্যক্তির সাথে সম্পৃক্ত। হাম্বলি আলেমগণ ও ইবন হাজম মনে করেন, পরিবারের জন্যও এই বিধি-নিষেধ প্রযোজ্য। এটাই উত্তম যে, সবাই চুল কাটা বা নখ কাটা থেকে বিরত থাকবে, হজের হাজিদের অনুসরণ করে।
ইমাম ইবন কুদামাহ رحمه الله বলেন, “যখন ব্যক্তি চাঁদ দেখাবে, তখন থেকে তাকে চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে সে যদি কাটে বা ছাঁটাই করে, তাহলে তার আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত, এবং এ ব্যাপারে আলেমদের মাঝে ঐক্যমত আছে যে এর জন্য কোন শাস্তি নেই, আর সেটা ইচ্ছাকৃত হোক বা অজান্তে।”
[আল-মুগনি]
মূসা عليه السلام এর সাথে আল্লাহর ﷻ কথোপকথন
আল্লাহ ﷻ এই দিনগুলিতে নবি মুসা عليه السلام এর সাথে সরাসরি কথা বলেছিলেন। আল্লাহ বলেন,
وَلَمَّا جَاءَ مُوسَىٰ لِمِيقَاتِنَا وَكَلَّمَهُ رَبُّهُ قَالَ رَبِّ أَرِنِي أَنظُرْ إِلَيْكَ قَالَ لَن تَرَانِي وَلَٰكِنِ انظُرْ إِلَى الْجَبَلِ فَإِنِ اسْتَقَرَّ مَكَانَهُ فَسَوْفَ تَرَانِي فَلَمَّا تَجَلَّىٰ رَبُّهُ لِلْجَبَلِ جَعَلَهُ دَكًّا وَخَرَّ مُوسَىٰ صَعِقًا فَلَمَّا أَفَاقَ قَالَ سُبْحَانَكَ تُبْتُ إِلَيْكَ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُؤْمِنِين
“মূসা যখন নির্ধারিত স্থানে উপস্থিত হল, তখন তার রাব্ব তার সাথে কথা বললেন। সে তখন নিবেদন করলঃ হে আমার রাব্ব! আপনি আমাকে দর্শন দিন। আল্লাহ বললেনঃ তুমি আমাকে আদৌ দেখতে পারবেনা, তবে তুমি ঐ পাহাড়ের দিকে তাকাও। যদি ঐ পাহাড় স্বস্থানে স্থির থাকে তাহলে তুমি আমাকে দেখতে পারবে। অতঃপর তার রাব্ব যখন পাহাড়ে জ্যোতিস্মান হলেন তখন তা পাহাড়কে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিল, আর মূসা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে গেল। যখন চেতনা ফিরে এলো তখন সে বললঃ আপনি মহিমাময়, আপনার পবিত্র সত্তার কাছে আমি তাওবাহ করছি এবং আমিই সর্বপ্রথম ঈমান আনলাম।”
আমাদের শিক্ষকদের উল্লেখ করেছেন যে, নবি মুসা عليه السلام এর সময় রোজা ৩০ দিন ছিল, যা ছিল জিলকদের দিন; তারপর আল্লাহ তাকে অতিরিক্ত ১০ দিন দেন, যা ছিল জিলহজের প্রথম ১০ দিন। আল্লাহ মুসা عليه السلام এবং বনি ইসরাইলকে পথ নির্দেশনা দিয়েছিলেন যখন তারা হারিয়ে গিয়েছিল এবং শিকার ছিল। আমদেরও এই ধরনের নির্দেশনা ও সাহায্যের খুবই প্রয়োজন। কিন্তু যা দরকার তা হলো আমল। মুসা عليه السلام নিজে আলোর দিকে গিয়েছিলেন নিজের বিষয়গুলো ঠিক করে। আলো তার কাছে আসেনি। আমাদের অবশ্যই বরকত পেতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
তাহলে কিভাবে আমরা এই ১০ দিনকে সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করতে পারি? এখানে কিছু বিষয়ের পরামর্শ থাকছে যা এই সময়টাতে করতে পারি:
রোজা ও নামাজ
আপনি যদি কোনো বড় ব্যক্তির কাছে যান এবং সাহায্য চান, আর তারা বলে, চিন্তা করো না, আমি তোমার ব্যাপারটা দেখছি, সব কিছু ঠিকঠাক করে দিচ্ছি, তখন যদিও তিনি নির্দিষ্ট করে কিছু বলেন নি তবুও আপনি নিশ্চিত জানেন একটা কিছু অবশ্যই হবে। ঠিক তেমনই, আমরা দেখি, আল্লাহ যিনি সবচেয়ে ক্ষমতাবান, সবচেয়ে দয়ালু ও দানশীল, তিনি রোজা সম্পর্কে কী বলেছেন।
একটি হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেছেন, “আদম সন্তানের সমস্ত কাজ তার নিজের জন্য, কিন্তু রোজা শুধু আমার জন্য, এবং আমিই এর পুরস্কার দেব।”
[বুখারি]
এটি এমন এক কাজ যার জন্য আল্লাহ নিজেই থেকে পুরস্কার দিবেন। কিন্তু কেন? কারণ কেউ চাইলেই খাবার খেতে ও পান করতে পারত, কিন্তু সে সম্পূর্ণ নিজ ইচ্ছাতে তা থেকে বিরত থাকে শুধুমাত্র তার রবকে খুশি করার জন্য। এটি সাধারণ দিনগুলোর জন্য। তাহলে জিলহজের বরকতময় ১০ দিনের সাথে একে একত্র করলে কেমন হয়? ভাবুন তো।
জিলহজের প্রথম নয় দিন রোজা রাখা খুবই সুপ্রতিষ্ঠিত, বিশেষ করে ৯ তারিখ, আরাফার দিন। আরাফার দিনে রোজার ফজিলত হলো দুই বছরের গুনাহের জন্য ক্ষমা লাভ।
আবু কা’তাদা আল-আনসারী رضي الله عنه বলেন, “রাসুল ﷺ কে আরাফার দিনে রোজা রাখার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বললেন, ‘আরাফার দিনের রোজা বিগত বছরের গোনাহ মাফ করে এবং আসন্ন বছরেরও।”
[মুসলিম]
এই দিনগুলো সাহাবাদের মধ্যে রোজার জন্য এতই জনপ্রিয় ছিল যে পরবর্তীতে আলেমগণ ভাবতে শুরু করলেন এই দিনগুলোতে রোজা রাখা ওয়াজিব কি না। তারা এই দিনগুলোতে রোজা রাখাকে সুন্নতে মোয়াক্কাদা (অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ) হিসেবে গণ্য করেন।
আবু সা’ঈদ আল খুদরী رضي الله عنه বলেন, আমি নবি ﷺ -কে বলতে শুনেছি, “নিশ্চয়, কেউ যদি আল্লাহর পথে একদিন রোজা রাখে (আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য), তবে আল্লাহ তার চেহারাকে জাহান্নামের আগুন থেকে সত্তর বছরের দূরত্বে রাখবেন।”
[বুখারি]
রমজানের অবশিষ্ট রোজার কাজা আদায়ের জন্য জিলহজের প্রথম দশ দিনের মধ্যে রোজা রাখাই যথেষ্ট। আশা করা যায়, রোজাদার একই সাথে এই ১০ দিনের ফজিলতও লাভ করবে। উমার رضي الله عنه বলেন, “রমজানের কাজা রোজা রাখার জন্য আমার কাছে এই দশ দিনের চেয়ে প্রিয় কোনও দিন নেই।” অনেক আলেম যেমন আবু হুরায়রা, ইবনে আল-মুসাইব, ইবনে নাখাই, হাম্মাদ বিন আবি সু’লইমানসহ অনেকে এই কথা বলেছেন।
উল্লেখ্য, প্রথম দশ দিন আসলে নয় দিন, কারণ একদিন হচ্ছে ঈদের দিন। একে জিলহজের প্রথম দশ দিন বলা হয়, কিন্তু এর নয় দিন রোজার জন্য দশম দিন ঈদের শুরু। কারণ ঈদের দিন রোজা রাখা নিষেধ, এ ব্যাপারে আলেমদের ঐক্যমত আছে। মনে রাখতে হবে এই ১০ দিনের আসল বরকত হলো দিনে, রাতে নয়। শইখ ইব্রাহিম নূহ حفظه الله বলেছিলেন, যদি কোনো ব্যক্তি এই দশ দিনে একটি ভালো কাজ করতে চায়, তাহলে তার উচিত রোজা রাখা।
ইমাম ইবন রাজব হাম্বলি رحمه الله বলেছেন, “জিলহজের প্রথম ১০ রজনিতে কিয়ামুল লাইলে দাঁড়ানোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ইমাম শাফেইসহ অন্যান্য আলেমগণ একে মুস্তাহাব (recommended) বলেছেন।” সাঈদ ইবনে জুবায়ের বলেছেন, এই দিনগুলোতে ইবনে আব্বাস নিজেকে তাঁর সামর্থ্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় নিয়ে যেতেন। তিনি আরও বলেছেন, ‘জিলহজের প্রথম দশ রজনিতে তোমরা বাতি জ্বালানো বন্ধ করে দিও, কারণ তিনি জিলহজের এই দিনগুলোত ইবাদতে মগ্ন থাকতে পছন্দ করতেন।’
[লাতাইফ ওয়াল মা’আরিফ]
অতিরিক্ত নফল নামাজ পড়ুন। সালাতুল দুহা ও বিতিরের নামাজের দিকে মনোযোগ দিন। ফজর নামাজ শেষে না ওঠে, সূর্য উঠার ১৫ মিনিট পর দুই রাকাত নামাজ পড়ুন। এর পুরস্কার হজ ও উমরাহর সমান।
আবু হুরায়রা رضي الله عنه বলেন, “যে ব্যক্তি জামাতে ফজর নামাজ পড়ার পর বসে থাকে, আল্লাহকে স্মরণ করে যতক্ষণ না সূর্য উদিত হয়, তারপর দু’রাকাত সালাত আদায় করে, তার জন্য পুরস্কার পূর্ণ, পূর্ণ, পূর্ণ হজ ও উমরাহর মত।”
[তিরমিজি]
এশা ও ফজর সালাত জামাতে পড়ুন। কেন? কারণ এটি পুরো রাতের নামাজের সমান। উসমান ইবনে আফফান رضي الله عنه বলেন, আমি নবি ﷺ কে বলতে শুনেছি, “যে ব্যক্তি এশার সালাত জামাতে পড়ল সে যেন অর্ধ রজনি সালাত আদায় করল, আর যে ব্যক্তি ফজরের সালাত জামাতে পড়ল, সে যেন পুরো রাত সালাত আদায় করল।”
[মুসলিম]
যেহেতু দিনের গুরুত্ব বেশি, তাই উচিত দ্রুত ঘুমাতে যাওয়া ও দিনটাকে যথাযথ কাজে লাগানোর চেষ্টা করা। কাজ বা ক্লাসের সময় রোজা রাখা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে, তবে বন্ধুদেরকেও এসব রোজা রাখতে বললে একসাথে রোজা থাকলে উৎসাহ বাড়বে— এটা অনেকটা বিগত রমজানের সময়ের মতো অনুভব হবে। আমাদের কাজ ও রোজার মাঝে আমরা আর কী করতে পারি তা হচ্ছে পরবর্তী আলোচনা।
আরাফার দিন
এই পবিত্র দিনগুলো বছরের অন্যতম সেরা দিনগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ বলেছেন:
وَالْيَوْمِ الْمَوْعُودِ وَشَاهِدٍ وَمَشْهُود
আর প্রতিশ্রুত দিনের শপথ (কিয়ামতের দিন); আর সাক্ষী হওয়া দিনের (শুক্রবার); এবং সাক্ষী নেওয়া দিনের (আরাফার দিন) শপথ। [সূরা আল-বুরুজ, ২-৩]
আরাফা একটি পর্বতশ্রেণীর নাম, যা মক্কার পূর্ব দিকে অবস্থিত, তার আশপাশের সমতল ভূমি সহ। ‘আরাফার দিন’ কেন নামকরণ হলো? ইমাম ইবনে আল-জাওজি رحمه الله বলেছেন, “এর দুটি কারণ রয়েছে তার মধ্যে একটি হলো: এই নামটি দেওয়া হয়েছে কারণ ফেরেশতা জিব্রীল عَلَيْهِ السَّلاَم নবি ইব্রাহীম عَلَيْهِ السَّلاَم -কে হজের রীতিগুলি দেখিয়েছিলেন এবং তারপর বলেছিলেন ‘তুমি কি এখন বুঝতে পেরেছ?” দ্বিতীয় কারণ (যার জন্য এটি এই নাম দেওয়া হয়েছে), “আদম ও হাওয়া عَلَيْهِمَا السَّلاَم জান্নাত থেকে বের হওয়ার পর এখানে (আরাফার পর্বতে) পুনরায় একে অপরকে ফিরে পেয়েছিলেন।”
[কাশফ উল-মুশকিল]
ইমাম ইবনে রাজাব আল-হানবালি رحمه الله বলেছেন: “এই কথার ভিত্তিতে, যদি আরাফার দিন একটি শুক্রবারে পড়ে, তাহলে ওই দিনে সাক্ষী এবং সাক্ষী গ্রহণের উভয় অংশ অন্তর্ভুক্ত হয়।” [লতাইফ ওয়াল মাআরিফ]
আরাফার দিন হলো জিলহজ মাসের নবম দিন। হজ পালনকারি একজন মুসলমানের জন্য নির্ধারিত যে, সে এই মহৎ দিনে আরাফা পর্বতে অবস্থান করবে। আরাফায় দাঁড়ানো হজের সবচেয়ে বড় স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়, কারণ নবি ﷺ বলেছেন, “হজ হলো আরাফা।”
এটি সেই দিন যখন আল্লাহ তাঁর ধর্মকে সম্পূর্ণ করেছেন এবং তাঁর অনুগ্রহকে পরিপূর্ণ করেছেন এবং আমাদের জন্য ইসলামকে একটি ধর্ম হিসেবে পছন্দ করেছেন। একদিন একজন ইহুদি উমর ইবনে আল-খাত্তাবের কাছে এসে বলেছিলেন: হে মুমিনদের নেতা! আমরা আপনার কিতাবে একটি আয়াত পড়েছি, যদি তা আমাদের উপর নাজিল হতো তবে আমরা সেই দিনটি ঈদ হিসেবে পালন করতাম। উমর বললেন, “কোন আয়াত?” ইহুদি বললেন: আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করেছি, আমার অনুগ্রহ তোমাদের উপর পূর্ণ করেছি এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য একটি ধর্ম হিসেবে পছন্দ করেছি। [সূরা আল-মায়িদাহ, ৩]
উমর رضي الله عنه বললেন, “আমরা নিশ্চিত জানি সেই দিনটি এবং যে স্থানে এটি নবি ﷺ-এর উপর নাজিল হয়েছে, সেটি জুমআর দিন আর তিনি আরাফায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।” [বুখারি]
আবু কাতাদাহ আল-আন্সারি رضي الله عنه বর্ণনা করেছেন, “আল্লাহর রাসুল ﷺ-কে আরাফার দিন রোজা রাখার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি ﷺ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আরাফার দিনে রোজা রাখলে পূর্ববর্তী বছরের এবং পরবর্তী বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যায়।” [মুসলিম]
ইমাম আল-নাওয়াই رحمه الله বলেছেন: “এর মানে হলো, এই রোজা রাখার ফলে দুই বছরের গুনাহ মাফ করা হয় এবং এর মাধ্যমে ছোট গুনাহগুলোই মাফ হয়, যেমনটি অযু করার মাধ্যমে গুনাহ মাফ হযইয়ে থাকে, যদি তেমন কোনো ছোট গুনাহ না থাকে তবে আশা করা যায় যে, বড় গুনাহগুলো থেকে কমানো হবে।” [শারহ সাহীহ মুসলিম]
ইমাম ইবনে আল-কাইয়িম رحمه الله বলেছেন, “দুটি দৃষ্টিকোণ রয়েছে: প্রথমটি হলো, আরাফার দিন একটি পবিত্র মাসে পড়ে, (যে মাসের) পূর্বে পবিত্র মাস থাকে; এবং (যে মাসের) পরে পবিত্র মাস থাকে, আশুরার বিপরীতে। দ্বিতীয়টি হলো, আরাফার দিনে রোজা রাখা আমাদের শরীয়তের বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যা আশুরার বিপরীতে।” [বাদায়ি’ আল-ফাওয়াইদ]
ইমাম আল-মন্নাউই رحمه الله বলেছেন: আল্লাহ তাঁর বান্দাকে আগামী বছরের গুনাহ থেকে রক্ষা করবেন যদি সে আরাফার দিনে রোজা রাখে। আল্লাহ আগামী বছরের গুনাহের সমান পুরস্কার দেবেন এবং এভাবেই আরাফার দিনে রোজা রাখলে গুনাহগুলো মুছে যায়। আল্লাহ আসলেই আগামী বছরের (ছোট) গুনাহগুলো মাফ করে দেন এবং মুছানো পূর্বে মুছানো হয়।
[ফাইদ আল-কাদীর]
আল্লাহ সেদিন তার অধিক সংখ্যক বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করেন অন্য দিনের তুলনায়। আল্লাহর রাসুল ﷺ বলেছেন, “এমন কোনো দিন নেই যেদিন আল্লাহ অধিক বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করেন, আরাফার দিন ছাড়া।” [মুসলিম]
ইমাম ইবনে রাজাব আল-হানবালি رحمه الله বলেছেন: “আরাফার দিন হলো জাহান্নাম থেকে মুক্তির দিন। আল্লাহ তাদেরকে মুক্তি দেন যারা (আরাফা পর্বতে) অবস্থান করছে এবং যারা (মুসলিম) সেখানে উপস্থিত না থাকলেও তাদেরকে মুক্তি প্রদান করেন। এর ফলে পরবর্তী দিনটি সমস্ত মুসলিমদের জন্য আনন্দ এবং উৎসবের দিন হয়ে ওঠে; যারা হজে অংশগ্রহণ করেছেন এবং যারা নেননি, তারা সবাই এতে অংশগ্রহণ করবে; যারা জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রাপ্ত এবং আল্লাহর ক্ষমা প্রাপ্ত।”
[লতাইফ আল-মাআরিফ]
ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে আল-মুবারক رحمه الله বলেছেন: “আমি আরাফার রাতে সুফিয়ান আল-সাওরির কাছে গিয়েছিলাম, তিনি হাঁটু গেড়ে বসে অতিরিক্ত কাঁদছিলেন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই সমাবেশের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় কে?’ আমি তাকে প্রশ্ন করলাম: ‘যে ব্যক্তি মনে করে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না।” [লতাইফ আল-মাআরিফ]
সেদিন আল্লাহ নিকটে চলে আসেন এবং তারপর তিনি ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করেন এবং বলবেন, ‘এই লোকেরা কী চাচ্ছে?’ আল্লাহ আরাফার মানুষের সম্পর্কে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করেন। আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন: আল্লাহর রাসুল ﷺ বলেছেন, “আল্লাহ আরাফার লোকদের সম্পর্কে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করেন। তিনি বলেন, ‘তাদের দেখো, যারা অব্যক্ত চুল এবং মাটিতে আবৃত।’” ইমাম ইবনে আবদুল-বার্ رحمه الله বলেছেন: “এটি দেখায় যে তারা ক্ষমা পেয়েছে কারণ ভুল ও গুনাহের সম্পর্কে গর্ব করা হয় শুধুমাত্র তাওবা এবং ক্ষমা লাভের পরে।” এবং আল্লাহর পৃথিবী আকাশে নেমে আসা সত্য, যা তাঁর মহিমা এবং মহানত্বের উপযুক্ত।
আরাফার দিনে দোয়া হল সেরা দোয়া। আমর ইবনে শুআইব তার পিতা ও দাদার মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন, আল্লাহর রাসুল ﷺ বলেছেন: “সেরা দোয়া হলো আরাফার দিনে করা দোয়া। আমি এবং পূর্ববর্তী নবিদের মধ্যে সবচেয়ে সেরা দোয়া হল:
لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
‘আল্লাহ ছাড়া সত্যি কোনো ইলাহ নেই, তিনি একক, কোনো শরীক নেই, তাঁরই রাজত্ব এবং তাঁরই প্রশংসা, তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাশীল।” [তিরমিজি]
ইমাম আল-নাওয়াউই رحمه الله বলেন, “এটি বছরের সেরা দিন দোয়া করার জন্য, সুতরাং ব্যক্তির জন্য উচিত যে, সে সম্পূর্ণভাবে তাঁর প্রচেষ্টা নিবেদিত করবে জিকির, দোয়া এবং কুরআন পাঠের মাধ্যমে; এবং তার উচিত বিভিন্ন ধরনের দোয়া করা এবং বিভিন্ন ধরনের জিকির পাঠ করা। তার উচিত নিজের, তার পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন, মাশায়েখ, সহকর্মী, বন্ধু, প্রিয়জন এবং যেকোনো লোকের জন্য দোয়া করা, যারা তার প্রতি সদয় ছিল, পাশাপাশি সমস্ত মুসলিমদের জন্যও। এবং তাকে এসবের মধ্যে কোনো কিছুতে খামতি না রাখার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে, কারণ এই দিনগুলো পুনরুদ্ধার করা যাবে না।“
তিনি আরো বলেন, “জেনে রাখো যে, অন্য যে কোনো দিনের তুলনায় এই দশটি দিনে জিকির করার পরিমাণ বাড়ানো পছন্দনীয় (মুস্তাহাব) । একইভাবে আরাফার দিনে জিকির আরও বেশি পছন্দনীয় (মুস্তাহাব)।“ [আল-আযকার]
ইমাম আল-নাওয়াউই رحمه الله বলেন, “আমরা সালিম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমরের কাছ থেকে শুনেছি, যে তিনি আরাফার দিনে একজন দোয়া প্রার্থীকে মানুষের কাছে প্রার্থনা করতে দেখেছিলেন, তখন তিনি বললেন: ‘হে দুর্বল লোক! এই দিনে আল্লাহ বাদে আর কারো কাছে দোয়া চাওয়া কি যুক্তিসঙ্গত?” [আল-আযকার]
ইমাম ইবনে আল-হুমাম رحمه الله বলেন, যে ইবনে উয়াইনা থেকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, “এটি তো প্রশংসা, তাহলে কেন আল্লাহর রাসুল ﷺ এটিকে দোয়া বললেন?” তিনি উত্তর দেন, “দানশীল ব্যক্তির প্রশংসা করা হল দোয়া করা, কারণ তিনি আপনার প্রয়োজন সম্পর্কে জানেন।“
আল্লাহর রাসুল ﷺ বলেন, “শয়তান কোনো দিন আরাফার দিনের মতো অপমানিত, বিতাড়িত বা রাগ অনুভব করে না। তা শুধুমাত্র এই কারণে যে, সে আল্লাহর রহমতের অবতরণ এবং বড় বড় অপরাধের ক্ষমা প্রত্যক্ষণ (এই দিনের মহান ক্ষমার কারণে) করে। এছাড়া যা তাকে বদরের দিনে দেখানো হয়েছিল তা।” [মুয়াত্তা]
কুরআনকে আপনার সঙ্গী বানানো
এটি আরেকটি সময় যা আল্লাহ আমাদেরকে কুরআনের সাথে আমাদের সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ দিয়েছেন এবং আল্লাহর কালামের মাধ্যমে তাঁর রহমত অনুভব করার সুযোগ দিয়েছেন। যদিও আমরা রমজান মাসের মত অতটা পড়তে পারি, তবুও চেষ্টা করা, কারণ আল্লাহর কাছে আমলের পরিমাণ নয়, গুণের গুরুত্ব বেশি।
তাহলে তাত্ত্বিকভাবে, যদি কুরআনের এক একটি অক্ষর দশটি ভাল কাজের সমান হয়, তবে বছরের সেরা এই পবিত্র ১০ দিনে প্রতিটি অক্ষর পড়ার জন্য কত পুরস্কার পেতে পারি, তা একবার কল্পনা করুন! বন্ধুদের সহায়তা নিলে কাজটি একইসাথে মজার এবং সহজ হয়ে যাবে।
আমরা যে দুঃসময়ে বাস করছি, এ সময় আল্লাহর বাণী আমাদের জন্য আশ্রয় এবং রহমতের উৎস হিসেবে কাজ করে। আল্লাহ বলেন,
وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ ۙ وَلَا يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلَّا خَسَارًا
“এবং আমরা কুরআন থেকে এমন কিছু অবতীর্ণ করি যা মুমিনদের জন্য শিফা ও রহমতস্বরূপ, কিন্তু এটি অন্যায়কারীদের ক্ষতি ছাড়া অন্য কিছুই বৃদ্ধি করে না।” [সূরা আল-ইসরা, ৮২]
আল্লাহ আরো বলেন,
وَهَٰذَا كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ مُبَارَكٌ
“এটি একটি বরকতময় কিতাব যা আমরা নাজিল করেছি।” [সূরা আল-আন’আম, ৯২]
এক সালাফ বলেছেন, “প্রতিদিন আমি আমার কুরআন তিলাওয়াতের অংশ বাড়ানোর সাথে সাথে, আমার সময়ে বারাকাহ (বরকত) বৃদ্ধি পেত। আমি এভাবে তিলাওয়াত বাড়িয়ে গেছি যতক্ষণ না আমার দৈনিক অংশ দশ আজযাতে (কুরআনের এক তৃতীয়াংশ) পৌঁছায়!“
কুরআনের প্রতিটি আয়াত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি আল্লাহর বাণী, কিন্তু কিছু আয়াত এমনভাবে আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে, যা আমাদের মনের অবস্থা এবং পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। কখনো কখনো এমন হয় যে, আমরা একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতির মধ্যে আছি এবং আকস্মিকভাবে কুরআনের একটি আয়াত শোনে বা পড়ে থাকি, যা আমাদের উদ্বেগের উত্তর দেয় বা যদি তা নাও হয়, তবে হৃদয় এবং মনকে শান্তি প্রদান করে।
ইমাম আল-সুয়ুতী رحمه الله বলেন, “এটি মুস্তাহাব (recommended) যে কুরআন গভীর চিন্তাভাবনার সাথে এবং বুঝে পড়া উচিত, কারণ সেটি হল সর্বোচ্চ লক্ষ্য এবং এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমে, হৃদয় আলোর দ্বারা পূর্ণ হয় এবং বিশ্রাম ও প্রশান্তি লাভ করে।“
যখন আমাদের পাশে কেউ থাকে না, আমাদের প্রয়োজনের সময়, তখন মনে হয় কুরআন যেন আমাদের সাথে কথা বলে এবং আমাদের শান্তনা দেয়। যদি আপনি ভাবেন যে, আপনি একা এ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তবে আপনি ভুল ভাবছেন। সমস্যা হলো, আমরা কুরআনকে একটি বই হিসেবে ভাবি কারণ আমরা এটি সবসময় বই হিসেবেই দেখেছি। কিন্তু কুরআন বই হিসেবে নাজিল হয়নি। বরং এটি ২৩ বছরব্যাপী ছোট ছোট অংশে নাজিল হয়েছিল, যা আমাদের প্রিয় নবি মুহাম্মদ ﷺ মুখোমুখী হয়েছেন এমন পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। কুরআনের যা কিছু আমরা দেখতে পাই তা অবচেতনভাবে আমাদের সাহায্য করে তা রাসূল ﷺ -এর জীবনে বাস্তবেই ঘটত।
ইমাম আল-লায়েছ رحمه الله বলেন: আল্লাহর রহমত সবচেয়ে দ্রুততর সেই ব্যক্তির উপর নেমে আসে, যে কুরআন শোনে, যেমন আল্লাহ বলেন:
وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
“যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তা শোনো এবং মনোযোগ দাও যাতে তোমরা রহমত প্রাপ্ত হও।” [সূরা আল-আরাফ, ২০৪]
তিনি বলেন, “আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করলাম: যদি শোনার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি এত রহমত প্রাপ্ত হয়;
- তাহলে কি কুরআন পড়া ব্যক্তি তার থেকে আরও বেশি রহমত পাবে না?
- কুরআন হেফজ করা ব্যক্তির জন্য কী হবে?
- কুরআনের অর্থ নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনাকারীর জন্য কী হবে?
- কুরআন অনুযায়ী কাজ করা ব্যক্তির জন্য কী হবে?”
তাকবির এবং জিকির
শাইখ সালেহ আল-মুনাজ্জাদ حفظه الله কে যখন তাকবির সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয় তিনি বলেন, “এই সময়ে তাকবির একটি সুন্নাহর অংশ, যা ভুলে যাওয়া হয়েছে, বিশেষ করে জিলহজের প্রথম দিকে, এটা এতটাই অবহেলিত সুন্নাহ যে, আপনি তা খুব কম লোককে করতে দেখবেন, কিছু লোক ছাড়া। এই তাকবির উচ্চস্বরে বলা উচিত, সুন্নাহকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য এবং অবহেলাকারীদের স্মরণ করানোর উদ্দেশ্যে। ইবনে উমর এবং আবু হুরাইরা প্রথম দশ দিন ধরে বাজারে বের হয়ে উচ্চস্বরে তাকবির বলতেন এবং লোকেরা তাদের তাকবির শোনার পর তাকবির বলত।“
ইমাম আল-বুখারি رحمه الله বলেছেন, “ইবনে উমর এবং আবু হুরাইরার َ رضِيَ اللهُ عَنْهُمَا প্রথম দশ দিন ধরে বাজারে বের হয়ে উচ্চস্বরে তাকবির বলতেন, এবং লোকেরা তাদের তাকবির শোনার পর তাকবির বলত।“
ইমাম ইবনে রাজাব رحمه الله বলেছেন, “এটা প্রমাণিত যে, এই দিনগুলিতে আল্লাহর নাম স্মরণ করা উচিত; এই প্রমাণ আল্লাহর বাণীতে পাওয়া যায়, ‘وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَّعْلُومَاتٍ ’ [সূরা আল-হজ, ২৮]। এই আয়াতের ব্যখ্যায়, প্রখ্যাত মুহাদ্দিসগণ বলেন যে, ‘এই দিনগুলি হল জিলহজের দশ দিন’।”
ইবনে উমর رضِيَ اللهُ عَنْهُمَا বলেন যে নবি ﷺ বলেছেন, “এই দশ দিন আল্লাহর কাছে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এবং প্রিয়, তাই এ দিনগুলিতে তাহলিল (لَا إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّٰهُ), তাকবির (ٱللَّٰهُ أَكْبَرُ) এবং তাহমিদ (ٱلْحَمْدُ لِلَّٰهِ) বেশি বেশি পড়তে হবে।“ [আহমদ]
ভুলে যাওয়া সুন্নাহ পুনরুজ্জীবিত করা এমন একটি কাজ যার পুরস্কার বিপুল, যেমন নবি ﷺ বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমার সুন্নাহর একটি দিকও পুনরুজ্জীবিত করবে যা আমার মৃত্যুর পর মানুষ ভুলে গেছে, তার পুরস্কার হবে তার অনুসরণকারীদের সমান, তাদের পুরস্কারের একটুকুও কমানো হবে না।”
الله أكبر، الله أكبر، الله أكبر، لا إله إلا الله . والله أكبر ، الله أكبر ، ولله الحمد
অনুবাদ: “আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।”
এটি ইমাম সাঈদ ইবনে জুবায়ের, মুজাহিদ, আবদুল রহমান ইবনে আবি লায়লা, ইসহাক ইবনে রাহওয়াহ এবং অন্যান্যদের থেকে বর্ণনা করা হয়েছে।
তাকবির ২ প্রকার:
- তাকবির মুতলাক (মুক্ত)
- কোথায়: যে কোন সময় এবং যে কোন স্থানে তাকবির বলা সুন্নাহ। সালাতের আগে এবং পরে জিকির করাও এর অন্তর্ভুক্ত।
- কখন: প্রথম জিলহজ থেকে শুরু করে ঈদের তৃতীয় দিন অর্থাৎ ১৩ ই জিলহজ (আল-তাশরিক দিবসগুলির শেষ দিন) পর্যন্ত। কিছু আলেমের মতে, তাকবির ঈদুল-আজহার খুতবার শেষ পর্যন্ত পড়া উচিত, যা ১০ ই জিলহজ।
জিলহজ মাসের এই তাকবীরের পুরস্কার অনেক বড়, এবং সাহাবাগণ প্রথম ১৩ দিন বাজারেও এই তাকবির পড়তেন।
- তাকবির মুকাইয়াদ (সীমাবদ্ধ)
- কোথায়: এটি সুন্নাহ (যারা হজে যাননি তাদের জন্য) যে তারা প্রতি নামাজের পর জামাতে তাকবির পড়বে। এটি শুধুমাত্র জামাতের নামাজের পরে সীমাবদ্ধ।
- কখন: ৯ জিলহজ অর্থাৎ আরাফাত দিবসের ফজর থেকে শুরু করে ১৩ ই জিলহজ এর আসরের সময় পর্যন্ত।
তাহলে, হজে না যাওয়া ব্যক্তি মোট ২৩টি নামাজের পর মুকাইয়াদ তাকবির পড়বে এবং হজে যাওয়া ব্যক্তি মোট ১৭টি নামাজের পর পড়বে। হজযাত্রীদের ১০ জিলহজ এর জোহর নামাজের পর থেকে তাকবির শুরু করা উচিত এবং ঈদের তৃতীয় দিন ১৩ ই জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলবে। এর আগে, হজযাত্রীরা ইহরাম অবস্থায় তলবিয়া পাঠ করতে থাকে।
মুকাইয়াদ তাকবির শুধুমাত্র জামাতে নামাজের পর পড়তে হবে, একাকি নামাজ বা নফল নামাজের পর নয়। ইবনে মাস’উদ বলেছিলেন, “তাকবির শুধুমাত্র তাদের জন্য যারা জামাতে নামাজ পড়েছে।” নামাজে সালামের পরে, তাকবির তৎক্ষণাৎ শুরু করা উচিত, এমনকি “আস্তাগফিরুল্লাহ” তিনবার বলার আগে এবং “আল্লাহুম্মা আনতা-স সালাম…” বলার আগে; তাকবির অন্য সব জিকিরের আগে পাঠ করতে হবে। যে ব্যক্তি নামাজ শেষ করতে দেরি করেছে (যেমন – ইমাম রাকাত শেষ করে ফেলেছে) তাকে তার নামাজ শেষ করার পর তাকবির পড়তে হবে।
মুতলাক তাকবির এবং মুকাইয়াদ তাকবির একত্র হয় ৫ টি দিনে:
১. আরাফাত দিবস (৯ জিলহজ)
২. নাহর দিবস (১০ জিলহজ)
৩. প্রথম তাশরিকের দিন (১১ জিলহজ)
৪. দ্বিতীয় তাশরিকের দিন (১২ জিলহজ)
৫. তৃতীয় তাশরিকের দিন (১৩ জিলহজ)
এই দিনগুলিতে নেক আমলের পুরস্কার বৃদ্ধি পায়। এটি আল্লাহর কাছ থেকে আমাদের জন্য একটি সহজ উপায়, যাতে আমরা তাঁর রহমত লাভ করতে পারি এবং আমাদের জান্নাতের জন্য বিনিয়োগ করতে পারি। আসুন, আমাদের জিহ্বা আল্লাহর জিকিরে ভিজিয়ে রাখি।
এমনকি ঈদের দিনেও আমরা দেখি যে, আমরা তাকবীরের সংখ্যা বাড়িয়ে দিই ফজরের পর, ঈদ নামাজের পথে, ঈদ নামাজের মধ্যে এবং পরে খুতবাতেও (৭ বা ৯টি তাকবির)। সাহাবাগণ তাদের ঈদের খুতবা তাকবির দিয়ে শুরু করতেন। ঈদের রাতগুলোতে আল্লাহর গৌরব এবং প্রশংসা বাড়ানো উচিত। আল্লাহ বলেন,
يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُوا۟ ٱلْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا۟ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
“আল্লাহ্ তোমাদের জন্য সহজ চান এবং তোমাদের জন্য কষ্ট চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূর্ণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন সে জন্য তোমরা আল্লাহ্র মহিমা ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।” [সূরা আল-বাকারা, ১৮৫]
শেখ আবদুল সালাম আল-শুয়াই’র حفظه الله বলেছেন, “ঈদের রাতে তাকবির সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সংখ্যায় বেশি কারণ এটি একাধিক প্রকারের তাকবীরের সংমিশ্রণ। সেগুলি কী কী?
- জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের মুতলাক তাকবির।
- ঈদের রাতের তাকবির।
- জামাতে নামাজের পর মুকাইয়াদ তাকবির।
মায়মুন ইবনে মিরহান رحمه الله বলেছেন, “আমি এমন সময়ে বেড়ে উঠেছি, যখন মানুষ প্রথম ১০ দিন এত পরিমাণ তাকবির বলত যে আমি তাদের তাকবিরকে তরঙ্গের মতো মনে করতাম এর ব্যাপকতার কারণে।” [ফাতহ আল-বারি]
মু’আজ ইবনে আনাস বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিলেন, “হে আল্লাহর রাসূল ﷺ! কোন জিহাদে সবচেয়ে বড় পুরস্কার হবে?” তিনি ﷺ বললেন, “যে জিহাদে আল্লাহর স্মরণ সবচেয়ে বেশি হয়।” এরপর ওই ব্যক্তি সালাহ, যাকাত, হজ এবং দান সম্পর্কে জানতে চান। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরেই, আল্লাহর রাসূল ﷺ বলেছেন, “যে জিহাদে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করা হয়।” (এটা শুনে), আবু বকর বললেন, “হে আবু হাফস! যারা আল্লাহর স্মরণে নিয়োজিত, তারা সমস্ত কল্যানে অংশ নিয়েছে!” আল্লাহর রাসূল ﷺ বললেন, “অবশ্যই!” [আহমাদ]
ইমাম ইবনে আল-জাওজি رحمه الله কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “আমার জন্য কি তাসবিহ (আল্লাহর গৌরব ঘোষণা) করা ভালো, নাকি ইস্তিগফার (আল্লাহর ক্ষমা চাওয়া)?” তিনি উত্তর দিয়েছিলেন: “ময়লা কাপড়ের সুগন্ধির চেয়ে সাবান বেশি প্রয়োজন।” [ফাতহ আল-বারি]
আমাদের উচিত আমাদের জিহ্বা সব সময় জিকিরে সিক্ত রাখা। আসুন কিছু উপকারিতা দেখি শুধুমাত্র একটি জিকির – “সুবহান আল্লাহ ওয়াবিহামদিহি” (سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ) বলার।
আল্লাহর রাসূল ﷺ বলেছেন, “যে ব্যক্তি প্রতিদিন একশো বার ‘সুবহান আল্লাহ ওয়াবিহামদিহি’ বলবে, তার সমস্ত গোনাহ মাফ করা হবে, যদিও সেগুলি সাগরের ফেনার মতো অনেক বেশি হয়।” [বুখারি]
আল্লাহর রাসূল ﷺ আমাকে বলেছিলেন, “তুমি কি জানো, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় শব্দ কোনটি?” এটি: “সুবহান আল্লাহ ওয়াবিহামদিহি” – আল্লাহ সকল ক্রুটি থেকে মুক্ত এবং প্রশংসা শুধু তারই। [মুসলিম]
প্রবীণ ﷺ বললেন, “যে ব্যক্তি বলবে: ‘সুবহান আল্লাহ ওয়াবিহামদিহি’ – আল্লাহ মুক্ত এবং তাঁর প্রশংসা রয়েছে, তার জন্য জান্নাতে একটি খেজুর গাছ লাগানো হবে।” [নাতাঈজ আল-আফকার]
আল্লাহর রাসূল ﷺ বলেছেন, “যে ব্যক্তি সকালে এবং সন্ধ্যায় (এই শব্দগুলি): “সুবহান আল্লাহ ওয়াবিহামদিহি” একশো বার পড়বে, সে কিয়ামতের দিনে এর চেয়ে উত্তম কিছু নিয়ে আসবে না, সেগুলি যারা এই শব্দগুলি বলবে অথবা তার চেয়ে বেশি বলবে।” [মুসলিম]
এই সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো অংশ হল যে, পুরস্কার অনেক বেশি এবং এর জন্য প্রায় কোনও পরিশ্রমের প্রয়োজন নেই। আমরা এটি গাড়ি চালানোর সময়, স্কুলে বা কাজে যাওয়ার পথে করতে পারি, বাড়ির কাজ, দায়িত্ব, হোমওয়ার্ক, যেখানেই হোক না কেন, যেকোন সময় এবং কোথাও। যখন আপনি এটি করতে শুরু করবেন, তখন এমন কিছু অনুভব হবে যেন আপনি শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছেন যা আপনি এতদিন ধরে খুঁজছিলেন, যেন আপনি আসলেই জানেন কেন আপনি এখানে আছেন এবং আপনি এটি বাস্তবায়ন করছেন। সত্যিই একটি আলোকিত অভিজ্ঞতা, আমি বলব। যদি আপনি সারাদিন তাকবির ঘোষণা করতে থাকেন, আমার ব্যক্তিগত পরামর্শ থাকবে যে, যতটা সম্ভব হাইড্রেটেড থাকার চেষ্টা করুন। পরের দিন প্রচুর পানি পান করুন, এটি অনেক সাহায্য করবে।
দান/সদকাহ
আল্লাহর রাসূল ﷺ বলেছেন: “এমন কোন দিন নেই, যখন নেক আমল আল্লাহর কাছে এই দশ দিনের চেয়ে বেশি প্রিয়।”
[ইবনে মাজাহ]
আমাদের উচিত এই বরকতময় সময়ের সুযোগ গ্রহণ করা, যেখানে নেক কাজগুলি অনেক বেশি পুরস্কৃত হয়। দান এমন একটি জিনিস, যা আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, রোজার পর আমাদের দিনামূলক কাজের জন্য পরিবর্তনকারী হতে পারে, যখন সেটা আল্লাহর পথে। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ﷺ এর উপর এতে যে চাপ দেওয়া হয়েছে, তা নজর না রাখা কঠিন। আল্লাহ বলেন,
مَّثَلُ ٱلَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمْوَٰلَهُمْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنۢبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِى كُلِّ سُنۢبُلَةٍۢ مِّا۟ئَةُ حَبَّةٍۢ ۗ وَٱللَّهُ يُضَـٰعِفُ لِمَن يَشَآءُ ۗ وَٱللَّهُ وَٰسِعٌ عَلِيمٌ
“যারা নিজেদের ধন সম্পদ আল্লাহ্র পথে ব্যয় করে তাদের উপমা একটি বীজের মত, যা সাতটি শীষ উৎপাদন করে, প্রত্যেক শীষে একশ শস্যদানা। আর আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছে বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেন। আর আল্লাহ্ সর্বব্যাপী- প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।” [সূরা আল-বাকারা, ২৬১]
ٱلَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمْوَٰلَهُمْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ ثُمَّ لَا يُتْبِعُونَ مَآ أَنفَقُوا۟ مَنًّۭا وَلَآ أَذًۭى ۙ لَّهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ
আল্লাহ বলেন: “যারা আল্লাহ্র পথে ধন-সম্পদ ব্যয় করে তারপর যা ব্যয় করে তা বলে বেড়ায় না এবং কোনো প্রকার কষ্টও দেয় না, তাদের প্রতিদান রয়েছে রাদের রব-এর নিকট। আর তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত ও হবে না।” [সূরা আল-বাকারা, ২৬২]
বর্ণনা করা হয়েছে যে আবু হুরাইরা رضي الله عنه বলেছেন: আল্লাহর রাসূল ﷺ বলেছেন: “যে ব্যক্তি একটি খেজুরের মূল্য দান করে – যে খেজুর হালাল উপার্জন থেকে হয় – আল্লাহ তা তাঁর ডান হাতে গ্রহণ করবেন এবং সেই দানের যত্ন নেবেন যেমন তোমাদের কেউ কারো ঘোড়ার দায়িত্ব নেয়, যতদিন না তা একটি পর্বতের সমান হয়ে ওঠে।” [বুখারি]
আমি মনে করি, আমাদের অবশ্যই পরবর্তীতে ভাল কাজের অনেক পাহাড় প্রয়োজন হতে পারে।
এই দশ দিনে, একটি বিষয় আমাদের নফসকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে, তা হল এই হাদিস। আবু হুরাইরাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল ﷺ বলেছেন: “আল্লাহ বললেন: ‘দান করো, হে আদম সন্তান, এবং আমি তোমার উপর ব্যয় করব।’” [বুখারি]
এখন আমি-আপনি কেবল কল্পনা করতে পারি এবং ব্যর্থ হতে পারি বার বার, যে আল্লাহ তাঁর পথে দান করা ব্যক্তিদের কী প্রতিদান দিতে পারেন। যা আপনার মাথায় আসে, এটি তার চেয়ে অনেক ভালো হবে।
কুরবানি / اُضْحِيَة (Udhiyah)
এই সময়েই اُضْحِيَة (উধিয়াহ) সম্পাদিত হয়। আদহা (أضحى) শব্দটি উধিয়াহ এর বহু-বচন, যার অর্থ হলো ঈদের দিনে সকাল (ضُحَى) বেলায় জবাই করা ভেড়া। তবে ঈদের চার দিনের মধ্যে যেকোনো সময় জবাই করা ভেড়াও উধিয়াহ বলে গণ্য হয়।
আয়িশা رضي الله عنها বর্ণনা করেন, নবি ﷺ বলেন:
“ঈদের দিনে এমন কোনো মানবিয় কাজ নেই যা আল্লাহর নিকট কুরবানির পশুর রক্ত ঝরানোর চেয়ে বেশি প্রিয়। সেই পশু কিয়ামতের দিনে তার শিং, পশম ও খুরসহ হাজির হবে। তার রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে যায়। অতএব, আনন্দের সাথে কুরবানি করো।” [তিরমিজি]
উধিয়াহ একটি সুন্নাহ এবং যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা করেন না, তা নিন্দনীয় ( مكروه )। এটি অত্যন্ত সুপারিশকৃত (recommended) সুন্নাহ (مؤكد)।
নবি ﷺ অক্ষম গরীবদের পক্ষ থেকেও অতিরিক্ত কুরবানি করতেন। ইমাম আহমদ رحمه الله বর্ণনা করেন:
“নবি ﷺ কুরবানি করতেন তার উম্মতের সেই ব্যক্তির পক্ষ থেকে, যে কুরবানি করতে অক্ষম এবং যে আল্লাহর একত্ব ও নবুয়তের সাক্ষ্য দেয়।” [আহমদ]সাহাবাগণ এই সুন্নাহ চালু রেখেছিলেন, যদিও আমাদের সময়ে তা বিস্মৃতপ্রায়। আনাস ইবন মালিক رضي الله عنه বলেন,
‘নবি ﷺ দুইটি ভেড়া কুরবানি করতেন, তাই আমিও দুইটি কুরবানি করি।’ [বুখারি]
এটি এমন একটি সুন্নাহ যা আমাদের সময়ে পুনর্জীবিত করা প্রয়োজন।
কুরবানির মাংস কীভাবে বণ্টন করবেন?
উধিয়াহ তিনভাগে ভাগ করা মুস্তাহাব (مستحب):
- খাওয়ার জন্য:
কুরবানিকারী নিজের জন্য এক-তৃতীয়াংশ রেখে দিবেন। - উপহার দেয়ার জন্য:
পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের মাঝে এক-তৃতীয়াংশ বিতরণ করবেন। - সদকা দেয়ার জন্য:
দরিদ্র, ক্ষুধার্ত ও বঞ্চিতদের মাঝে এক-তৃতীয়াংশ দান করবেন।
এই মতটি আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ ও ইবন উমর رضي الله عنهما -এর।
মাংস বণ্টনের সময় কিছু আদব পালন করা উত্তম:
- সদকার জন্য সবচেয়ে উত্তম অংশ,
- উপহারের জন্য মধ্যম মানের অংশ,
- নিজের খাওয়ার জন্য সাধারণ অংশ রাখা।
দুআ ও সম্পর্ক
পরিবার – তারা মাঝে মাঝে আমাদের বিরক্ত করতে পারে, বকা দিতে পারে, উপদেশ দিতে পারে এবং সবচেয়ে কঠিন হলো পরীক্ষার রেজাল্ট বা বেতনের খোঁজ নিতে পারে। কিন্তু দিন শেষে, আল্লাহ আমাদের পরিবারে সৃষ্টি করেছেন যাতে আমরা একে অপরকে সাহায্য ও দেখাশোনা করতে পারি।
জিলহজের এই ১০ দিনে পরিবারের সাথে ভালো আচরণ করার চেষ্টা করা, বিশেষ করে যাদের সাথে দীর্ঘদিন ধরে কথা হয়নি। শুধু তাই নয়, আপনার প্রশস্ত পরিবার হল আপনার প্রতিবেশীরা—তাদেরকেও ভুলে যাবেন না। হাসিমুখে থাকুন, কারণ হাসিও একটি সদকা। একটি হাসিমুখ ও সালাম কাউকে আনন্দ দিতে পারে। হয়ত সেটাই তার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল।
একটি সুখী পরিবার ও পরিবেশ আমাদের ঈমান ও কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে, যা উম্মাহর উন্নতির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। এই কাজগুলো দেখতে ছোট মনে হলেও, ঠিক এই ছোট ছোট পাথরগুলোই একটি নেক কাজের ঢল নামিয়ে আনে।
শেষ কথা, দুআ করুন
একটি শিশুর মতো কাঁদুন, যেমন সে তার মায়ের কাছে কাঁদে। শিশুটি ভুল করলে মা হয়তো তাকে কিছু সময়ের জন্য রুমে আটকে রাখে, কিন্তু সে কাঁদলে মা শেষে ক্ষমা করে তাকে বুকে টেনে নেয়।
তাহলে চিন্তা করুন আল্লাহর ব্যাপারে, রাসূল ﷺ বলেছেন যে, আল্লাহ আমাদের নিজের মায়ের চেয়েও ৭০ গুণ বেশি ভালোবাসেন!
নিজের জন্যই শুধু নয়, অন্যদের জন্যও দুআ করুন। কারণ, যখন আপনি কারো অজান্তে তার জন্য দুআ করেন, তখন ফিরিশতারা আপনার জন্য একই দুআ করেন।
- আপনার পিতা-মাতা,
- শিক্ষকগণ,
- উলামায়ে কিরাম,
- এবং সমগ্র উম্মাহর জন্য দুআ করুন।
কী জানি, হতে পারে আপনারই দুআ আল্লাহ কবুল করবেন এবং এই ঘুমন্ত জাতিকে আবার জাগ্রত করবেন। এটি একটি উইন-উইন চুক্তি, যা প্রমাণ করে আল্লাহ আমাদের কতটা ভালোবাসেন এবং আমাদের জন্য পথচলা কত সহজ করে দিয়েছেন।
ইমাম আন-নববী رحمه الله বলেন:
“জেনে রাখো, এই (গুণবতী) দশ দিনে অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশি দুআ করা মুস্তাহাব। বিশেষ করে আরাফার দিন তো আরও বেশি দুআ করার জন্য বলা হয়েছে।” [আল-আযকার]
আল্লাহর আমাদের সদকা, টাকা, রোজা বা দুআর কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি এসবের ঊর্ধ্বে। বরং আমরাই সবসময় তাঁর মুখাপেক্ষী। যখন আপনি সদকা দেন, তখন মনে রাখবেন আপনি কারো উপকার করছেন না বরং আল্লাহ আপনাকে তার অনুগ্রহ ছড়িয়ে দেয়ার একটি মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছেন, এর জন্য কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।
হতে পারে আপনার পরিবার বা বন্ধুবান্ধব এই মাসের গুরুত্ব জানে না। আল্লাহ আমাদের জন্য পথচলা সহজ করতে চান, এবং তিনি আমাদের মায়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। তিনি আমাদের জীবনে একটি চিট-কোড দিয়েছেন। জানেন সেটা কী?
উপকারি জ্ঞান অন্যদের সাথে শেয়ার করুন। যদি তারা তাতে আমল করে, তাহলে আপনিও তাদের আমলের সওয়াব পাবেন, ঠিক যেন আপনি নিজেই তা আমল করেছেন।
তবে এর অর্থ এই নয় যে, আপনি নিজের আমল বাদ দিতে পারেন।
আল্লাহ আমাদের এই বরকতময় দিনগুলো সর্বোত্তমভাবে কাজে লাগানোর তাওফিক দিন এবং তাঁরই সন্তুষ্টির উদ্দ্যেশ্যে করা আমাদের সামান্য আমলকে কবুল করে নিন। সেই আমল যেন আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতার মাধ্যম হয়।
No Comment! Be the first one.